পুলিৎজার প্রাপ্ত

ফিলিস্তিনি কবির কবিতায় দুর্দশার চিত্র

পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন ফিলিস্তিনি কবি, ছবি: সংগৃহীত

মোসাব আবু তোহা একজন ফিলিস্তিনি কবি, ছোটগল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর বই থিংস ইউ ম্যা ফাইন্ড হিডেন ইন মাই ইয়ার দ্য ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক এওয়ার্ড পুরষ্কারের জন্য চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পায়  এবং ডেরেক ওয়ালকট পোয়েট্টি পুরষ্কার ও আমেরিকান বুক এওয়ার্ড লাভ করে। তোহা এডওয়ার্ড সাঈদ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৯-২০২০ সালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি কবি ও আবাসিক লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার প্রবন্ধ ও  কবিতায় যুদ্ধবিধবস্ত ফিলিস্তিনের মাটি ও মানুষের প্রতি একটা অবিচ্ছেদ্য টানের প্রকাশ যায়।

তোহা এই বছর পুলিৎজার পদকে ভূষিত হয়েছেন। দ্য নিউ ইউয়ার্কারে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলনে মোসাব যুদ্ধবিধস্ত গাজাবাসীদের জীবন ও ভোগান্তির কথা তুলে ধরেছেন। পুরস্কার লাভের পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন,'এটা একটা আশার সঞ্চার করুক। এটাই হোক একটা গল্প।' 

৩২ বছর বয়সী আবু তোহা ২০২৩ সালে স্ত্রী ও তিনসন্তানসহ ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর হাতে আটক হন। ইজরায়েলীদের হাতে বন্দী থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন,' সেনারা আমাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে মারধর করে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে  মোসাবের  বন্ধুরা  তাঁর মুক্তির জন্য  আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করলে মোসাব ইজরায়েলী বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পান এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।  যুদ্ধাক্রান্ত গাজায় তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের খাদ্যের অভাব এবং প্রতি  বেলা খাবারের জন্য কী পরিমাণ যন্ত্রণা তাঁদেরকে পোহাতে হয় সেটা তুলে ধরেছেন" যুদ্ধের দিনগুলোতে প্রাত্যহিক খাবার" নামক কবিতায়। মোসাবের আকুতি অনুবাদ করে বলা যায়, 'আমি আমার জন্মভূমি গাজায় ফিরে যেতে চাই। রান্নাঘরে মা-বাবার সাথে একসাথে বসে খেতে চাই, এবং আমার বোনদেরকে চা বানিয়ে খাওয়াতে চাই। আমার খাবারের প্রয়োজন নেই। আমি তাদের সাথে আবার  দেখতে চাই।'

যুদ্ধবিধস্ত গাজাবাসীর ভোগান্তি ও দুর্দশার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে আবু তোহার কবিতায়। মোসাবের এক গুচ্ছ কবিতা অনুবাদ করেছেন আলমগীর মোহাম্মদ।

যুদ্ধের দিনগুলোতে প্রাত্যহিক খাবার

আগে যুদ্ধের দিনগুলোতে আমাদের প্রতিবেশীরা বেইজমেন্টে আমাদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করে খেতেন। আমার ভাই পুরনো কাঁসারীতে আগুন জ্বালাতো আর আমি চা বানাতাম এবং জ্বলন্ত কয়লার উপর কেতলি বসাতাম।
প্রায় প্রতি দুইদিন পর পর সাময়িক যুদ্ধবিরতি হতো। আমার বাবা বের হয়ে খোয়াড়ে রাখা হাঁসমুরগিগুলোকে দেখে আসতেন। মা মই বেয়ে ছাদে উঠে একটা পাত্রে করে চড়ুই ও কবুতরের জন্য পানি রাখতেন।
প্রায়ই পুরুষ মানুষদেরকে জেল অথবা কন্সট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হতো। তাঁরা দেখতে পারতেন কারা যুদ্ধ করছে এবং কারা তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করছে।
আজকাল আমরা ঘাতকদের দেখতে পাই না যারা আমাদের কাছ থেকে যা কিছু সুন্দর তার সবকিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে। আমরা দিনে নিজেদের ছায়া দেখতে পাই না। এফ-ষোলোগুলো আমাদেরকে দিনের আলো থেকে বঞ্চিত করছে, তাদের স্নেহযুক্ত পেটের ছায়া ফেলছে আমাদের উপর, জীবিত বা মৃত।
বোমার আঘাতে ঘরবাড়ি উড়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে, ফ্রিজ ও রান্নাবাড়া মিশে যাচ্ছে ধুলোয়। একেকটা ঘর হয়ে উঠছে রক্ত ও কংক্রিটের কড়াই। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে এখন আর খাবার ভাগাভাগি করি না। 

আমার দাদাভাই ও বাড়ি

আমার দাদাভাই ফেরার জন্য দিন গুনতেন আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে
তিনি তারপর পাথর ব্যবহার করতেন গোনার কাজে
যথেষ্ট না তিনি ব্যবহার করতেন মেঘ, পাখি ও মানুষকে
অনুপস্থিতিটা বেশ দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিলো
তাঁর মৃত্যু আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছয়ত্রিশ বছর
আমাদের জন্য এখন তা সত্তর বছরের চেয়েও বেশি
আমার দাদাভাই স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন
তিনি জনসংখ্যার হিসেবে ভুলে গিয়েছিলেন
তিনি তাঁর বাড়ির কথা ভুলে গিয়েছিলেন

খ ।

যদি আমি তোমার সঙ্গী হতে পারতাম, দাদাভাই!
আমি যদি নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে পারতাম তোমাকে লেখার জন্য
অনেক অনেক কবিতা এবং তোমার জন্য আমাদের ঘরের পেইন্টিং আঁকতে পারতাম
আমি হয়তো মাটি থেকে তোমাকে রোপণ করতাম
গাছের চারায় সজ্জিত একটা পোশাক
এবং যে গাছগুলো তুমি বড় ক'রেছিলে
আমি যদি তোমার জন্য পারফিউম তৈরি করতে পারতাম
কমলা থেকে
এবং অনন্দময় অশ্রুসিক্ত আকাশ থেকে সাবান তৈরি করতে পারতাম
আসলে এর চেয়ে বেশি খাঁটি কিছুর কথা ভাবতে পারিনি

গ ।

আমি প্রতিদিনই কবরস্থানে যাই
আমি তোমার কবর খুঁজি কিন্তু ব্যর্থ হই
আচ্ছা, তারা কি নিশ্চিত তোমাকে সমাহিত করেছিল
নাকি তুমি একটা গাছে রূপান্তরিত হয়ে গেছো?
অথবা তুমি কোনো একটা পাখির সাথে উড়ে শূন্যে চলে গেছো!

ঘ।

একটা মাটির পাত্রে আমি তোমার ছবি রেখেছি
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার সূর্যাস্তে আমি এতে জল দিই
আমি জেনেছি তুমি সেদিনগুলোতে রোজা করতে
রমজানের সময় আমি প্রতিদিন এতে পানি দিই
ত্রিশ দিন ধরে
এর কম বা বেশি বার।

ঙ.

আমাদের কত বড় বাড়ি চাও তুমি
তুমি খোশ না হওয়া পর্যন্ত আমি কবিতা লিখতে পারব তোমার জন্য
তুমি যদি চাও আমি দুয়েকটা প্রতিবেশী প্ল্যানেটও যুক্ত করতে পারব

চ।
এই বাড়ির জন্য আমি কোনো সীমানা টানব না
কোনো ইতি চিহ্নও না।

নিহত সন্তানের স্মৃতি 

এক বাবা রাতে জেগে উঠে দেখলেন
ঘরের দেয়ালগুলো এলোমেলো রংয়ে ভ'রা
তাঁর চার বছর বয়সী সন্তানের আঁকা।
কিন্তু, শিশুটি  একটি বিমান হামলায় মারা গেছে। 
আঁকা রংগুলো প্রায় চার ফুট দীর্ঘ
পরের বছর সেগুলো হয়তো পাঁচ বা ছয় ফুট হতো!
কিন্তু, যে এঁকেছে সে মারা গেছে এবং
যাদুঘরে এখন নতুন
কিছু চিত্র শোভা পাচ্ছে। 
 

ফুঁড়ে বের হচ্ছে গোলাপ

কখনো বিস্মিত হয়ো  না
একটি গোলাপ ফুঁড়ে বের হতে দেখে
গুড়িয়ে দেওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে:
এভাবেই আমরা টিকে আছি। 
রাস্তায় দরোজা
শরণার্থী ক্যাম্পে,
বোমা ফাটার পর, দূরের রাস্তায় একটা দরোজা উড়ে এসে
ভাঙাচোরা ইট-পাথরের  স্তূপের পাশে পড়েছে।
ধুলোর মেঘ জন্ম দিয়েছে কাশির,
প্রতিবেশী ঘরগুলোতে--
তীব্র উষ্ণ হাওয়ার আক্রমণে
সদস্যদের নাক ফুলে গেছে।
একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, রক্তাক্ত দরোজাটা তার নজরে পড়েছে। সে দরোজাটা খুলে দেখলো একটা লাশ
দরোজার নিচে চাপা পড়ে আছে।
মাটি থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে৷ যদিও কয়েকটা আঙ্গুল কাটা,
এখনো মৃত যুবক তার হাতে এখনো আঁকড়ে আছে,
একটা অতি পুরনো চাবি- সে বাবার কাছ থেকে শুধু এটাই পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে। ঈয়াফাতে তাদের বাড়ির চাবি এটা। সে নিশ্চিত জানতো বাড়িটা গুড়ে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু, এই চাবিটাই তার জন্য পাসপোর্ট হতে পারে ঈয়াফাতে ফিরে যাওয়ার। এখন সে ও শরণার্থী ক্যাম্পে তাদের বাড়ি, এই দুইয়ের অস্তিত্ব নেই ঘুরে দাঁড়ানোর ।

মেয়েটি দরোজাটা বন্ধ করে দিলো। কান্নায় তার বুক ফেটে গেলো। 

Comments

The Daily Star  | English

Pakistan says it has launched military offensive against India

Locked in a longstanding dispute over Kashmir, the two countries have engaged in daily clashes since Wednesday

51m ago