আফ্রিকায় বন্ধু খুঁজছে মধ্যপ্রাচ্যে ‘নিঃসঙ্গ’ ইরান

আফ্রিকার এই নেতাদের মধ্য থেকেই হয়তো বের হয়ে আসবে ইরানের ভবিষ্যতের মিত্ররা। ছবি: ইরানের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ওয়েবসাইট
আফ্রিকার এই নেতাদের মধ্য থেকেই হয়তো বের হয়ে আসবে ইরানের ভবিষ্যতের মিত্ররা। ছবি: ইরানের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ওয়েবসাইট

মধ্যপ্রাচ্যে এখন অনেকটাই 'নিঃসঙ্গ' ইরান। হিজবুল্লাহ-হামাস-হুতিদের নিয়ে তেহরান যে 'প্রতিরোধ বলয়' গড়ে তুলেছিল তা শত্রু ইসরায়েলের আঘাতে-প্রত্যাঘাতে 'লণ্ডভণ্ড'। এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সিরিয়া এখন 'হাতছাড়া'। লেবাননও 'হাতে নেই'।

দীর্ঘ সীমান্তের কারণে প্রতিবেশী ইরাকের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক আছে তা মূলত 'স্বার্থ কেন্দ্রিক'। সেখানকার ইরানপন্থি বা ইরান-সমর্থিত প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখন যেন 'শীত নিদ্রায়'।

এক দেশে দুই সরকার থাকার কারণে বন্ধু ইয়েমেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায় এখন 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'।

মধ্য এশিয়ার তুর্কী জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত দেশগুলোয় তুরস্কের প্রভাব বেশি। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ইরান সেখানে অনেকটাই 'ব্রাত্য'। দক্ষিণ এশিয়ায় ইরানের গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে।

ইরান এক সময় লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছিল। কিন্তু, তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ভেনেজুয়েলা ও কিউবাকে পাশে পেয়েছিল কিছুদিনের জন্য। সময়ের পরিক্রমায় সেখানে 'শূন্যতা' সৃষ্টি হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় অঞ্চলের খনিজসমৃদ্ধ ইরানের বন্ধু প্রয়োজন। নতুন নতুন বন্ধু।

ইরানের আফ্রিকা সম্মেলনে নেতারা। ছবি: ইরানের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ওয়েবসাইট

গত ২৬ এপ্রিল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ শহর বন্দর আব্বাসের শহিদ রাজাঈ বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। বিস্ফোরণে অন্তত ২৮ জন নিহত ও আট শতাধিক মানুষ আহত হলেও পরের দিনই রাজধানী তেহরানে আয়োজন করা হয়েছিল তৃতীয় ইরান-আফ্রিকা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্মেলন। সেই সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম না হলেও প্রকাশিত হয়েছিল স্থানীয় পত্র-পত্রিকায়।

সরকার-নিয়ন্ত্রিত প্রেস টিভি জানায়—আফ্রিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায় ইরান। সেই লক্ষ্যেই তেহরানে আয়োজন করা হয়েছে ইরান-আফ্রিকা সম্মেলন। চার দিনের সেই অনুষ্ঠানে মহাদেশটির ৩৮ দেশের ৭০০-র বেশি ব্যবসায়ী অংশ নেন।

সংবাদ সংস্থা ইরানিয়ান স্টুডেন্টস নিউজ এজেন্সির (আইএসএনএ) প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মন্ত্রীসহ ৫০ জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা সম্মেলনে অংশ নেন।

মেহর নিউজ এজেন্সি জানায়, তেহরানে শুরু হওয়া সম্মেলনটি শেষ হয় ঐতিহাসিক শহর ইস্পাহানে। অতিথিদের সামনে ইরানের শিল্প সক্ষমতা তুলে ধরা হয়।

গত ২৮ এপ্রিল সম্মেলনের অংশ হিসেবে তেহরানে 'ইরান এক্সপো'র আয়োজন করা হয়েছিল।

কী নিয়ে সহযোগিতা?

গত ৪ মে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস জানিয়েছে—অনুষ্ঠানের শেষদিনে ইরান-আফ্রিকা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্মেলনের সচিব সৈয়দ মেহদি হোসেইনি আফ্রিকান ও ইরানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের চারটি ক্ষেত্রে চুক্তি হওয়ার কথা জানান। ক্ষেত্রগুলো হলো—খনিজ, কৃষি, পেট্রোক্যামিকেল ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি।

তার ভাষ্য, আগের দুই সম্মেলন থেকে এই সম্মেলনটি আলাদা ছিল। সর্বশেষ সম্মেলনে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে। তাই আগের দুই সাধারণ সম্মেলন তুলনায় এবারের সম্মেলন ছিল অধিক ফলপ্রসূ। চুক্তি করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এবারের সম্মেলনের অনুষ্ঠানসূচি সাজানো হয়েছিল।

এবারের সম্মেলনটি পুরোপুরি রাজধানী-কেন্দ্রিক ছিল না। তেহরানে প্রাথমিক আলোচনা শেষে অতিথিরা তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১৫ দলে বিভক্ত হয়ে ইস্পাহানে মাঠ পর্যায়ে সফরে যান।

তারা তাদের নিজ নিজ আগ্রহ মোতাবেক বাণিজ্যিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সফর করেন। যেমন, আফ্রিকান প্রতিনিধি দলের যাদের খনিজসম্পদ নিয়ে আগ্রহ ছিল তারা ইরানের খনির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা, আলোচনা ও চুক্তি করেন।

তৃতীয় ইরান-আফ্রিকা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। ছবি: ইরানের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ওয়েবসাইট
তৃতীয় ইরান-আফ্রিকা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। ছবি: ইরানের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ওয়েবসাইট

আফ্রিকা ও ইরানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে স্মারক চুক্তি সই করেছেন বলেও জানান সম্মেলন সচিব সৈয়দ মেহদি হোসেইনি। তিনি আরও জানান, অতিথিদের ২০ শতাংশ ইরানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও জানতে সম্মেলন শেষ হওয়ার পরও বেশ কয়েকদিনের জন্য সফর দীর্ঘায়িত করেন।

এবারের ইস্পাহানের মতো আগামী সম্মেলনে কেরমান ও তাবরিজ প্রদেশে অতিথিদের নিয়ে যাওয়া হবে বলেও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কেরমান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এবং তাবরিজ ট্রাকটর ও কার্পেট উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।

সম্মেলনের অগ্রগতি ও চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যালোচনার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে একটি স্থায়ী কার্যালয় গড়া হয়েছে। তাই বলা যেতে পারে—ইরানের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর সম্মেলন নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, এর প্রায়োগিক গুরুত্বও আছে।

সম্মেলনে ইরানের শিল্প, খনিজ ও বাণিজ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আতাবেক জানান, বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশে ইরানের রপ্তানি দেশটির মোট রপ্তানির মাত্র তিন শতাংশ ও মোট আমদানির এক শতাংশ। অর্থমূল্যে এটা প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার। তিনি এই বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার আশা করছেন।

আফ্রিকার সঙ্গে আকাশ ও জলপথে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি।

আফ্রিকার গুরুত্ব

ইরানের কাছে আফ্রিকার গুরুত্বের কথা উঠে আসে গত ২৯ এপ্রিল তেহরান টাইমসের এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করা অনেকগুলো কারণে জরুরি।

সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা সদরদপ্তরের পরিচালক জাভেদ দেগঘান হাঘিঘি বলেন, 'ইরান ও আফ্রিকার সম্পর্কের ভিত্তি হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। ইরানি ও আফ্রিকানরা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অন্য অনেক দেশের মধ্যে বিষয়টা এরকম নয়। পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্ক উপনিবেশবাদ ও শোষণের কারণে তিক্ত।'

তবে ইরান ও আফ্রিকার মধ্যে বিশেষ কোনো শত্রুতা নেই।

ইরানের শহীদ রাজয়ি বন্দরে বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরও নেভেনি আগুন। ছবি: এএফপি
ইরানের শহীদ রাজয়ি বন্দরে বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরও নেভেনি আগুন। ছবি: এএফপি

তিনি মনে করেন, ইরান প্রযুক্তি ও শিল্প সংক্রান্ত তথ্য আফ্রিকার সঙ্গে আদানপ্রদান করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কৃষি খাতেও সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে। আফ্রিকার বিপুল খনিজ সম্পদ ও বিশাল বাজার ইরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সাদা চোখে আফ্রিকার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা মূলত অর্থনৈতিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমাগত বন্ধুহীন হয়ে পড়া এবং পশ্চিমের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান এমন এক মহাদেশের দিকে হাত বাড়িয়েছে যেখানে এশিয়ার অন্যতম দুই শীর্ষ অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারত আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে।

এ ছাড়াও, আফ্রিকা থেকে ইউরোপের সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে সরিয়ে সেখানে সামরিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে ইউক্রেনে আগ্রাসনের দায়ে পশ্চিমের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়া।

এমন পরিস্থিতিতে, মধ্যপ্রাচ্যে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া ইরান আফ্রিকায় কতটা সুবিধা করে উঠতে পারবে তা দেখার বিষয়।

Comments

The Daily Star  | English

India restricts land port imports of Bangladesh’s RMG, food

India has imposed new restrictions on the imports of key goods from Bangladesh, including garments and agro-processed food, through land ports, a move expected to disrupt trade flows and add logistical hurdles for exporters..According to a notification issued today by India’s Directorate G

1h ago