আলুর বাম্পার ফলনেও চাষির কান্না

ছবি: মো. কামরুল ইসলাম রুবাইয়াত

আলুর বাম্পার ফলন ও তিন বছরের মধ্যে চলতি অর্থ বছরে সর্বোচ্চ রপ্তানি সত্ত্বেও চলতি মৌসুমে লোকসান গুণতে হয়েছে দেশের অনেক চাষিকে। কারণ বাজারে আলুর দাম এত কম যে, তাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বলছে—চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত আলু রপ্তানি হয়েছে ৪৮ হাজার ১৭৭ টন। গত অর্থবছরে তা ছিল ১২ হাজার ১১২ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৩২ হাজার ৩৯২ টন।

দেশের আলু উৎপাদনের হাব হিসেব পরিচিত কয়েকটি জেলার কৃষকেরা জানিয়েছেন, হিমাগারে পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়ায় উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে তারা আলু বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এদিকে, গত মৌসুমে চড়া দামের কারণে ভালো লাভের আশায় চলতি মৌসুমে আলু চাষ বাড়িয়ে দেন চাষিরা।

সাধারণত অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে আলু রোপণ করা হয়। তোলা হয় ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে—চলতি মৌসুমে রেকর্ড পাঁচ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আগের মৌসুমের তুলনায় যা ১৫ শতাংশ বেশি।

গত বছর প্রতি কেজি আলুর দাম ৮০ টাকায় উঠছিল। চলতি মৌসুমেও চাষিরা একই রকম লাভের আশা করেছিলেন।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে—গতকাল ঢাকায় প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ১৮ থেকে ২৫ টাকায়। গত বছর এ সময় দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫০-৫৫ টাকা।

এদিকে, গত এক সপ্তাহে আলুর দাম কমেছে চার দশমিক ৪৪ শতাংশ।

ঢাকার অন্যতম বৃহৎ কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারের আলুর পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ কাইয়ুম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সরবরাহ সংকটের কারণে পাঁচ দিন আগেও প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ১৫-১৬ টাকায়।

তবে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এখন আলুর দাম কেজি প্রতি ১২-১৩ টাকায় নেমে এসেছে।

এদিকে মুন্সীগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও জয়পুরহাটের মতো আলু উৎপাদনকারী জেলায় চাষিরা জানিয়েছেন তারা কেজিপ্রতি দাম পাচ্ছেন ১০-১১ টাকা। এটি উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে—চলতি মৌসুমে দেশে আলুর গড় উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ১৪ টাকা। উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য তা ছিল কেজিপ্রতি প্রায় ২০ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিস উইংয়ের পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, চলতি মৌসুমে দেশে রেকর্ড এক কোটি ২৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। যা দেশের বার্ষিক প্রায় ৯০ লাখ টন আলু চাহিদাকে ছাড়িয়ে গেছে।

যদিও সরকার ধারণা করছে যে, হিমাগার সুবিধার ত্রুটির কারণে মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ আলু নষ্ট হয়। এই অতিরিক্ত সরবরাহ ছোট ছোট চাষিদের সামান্য স্বস্তি দিতে পারে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কৃষক নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি ২৩ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে পেয়েছেন দুই হাজার ৭০ মন।

প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ ১৮ টাকা হলেও তিনি এখন বাধ্য হয়ে আট থেকে ১০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছেন। ভরা মৌসুমে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকায়।

তিনি জানান, পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়ায় এক হাজার বস্তার পরিবর্তে তিনি ৩০০ বস্তা আলু হিমাগারে রাখতে পেরেছেন। প্রতি বস্তায় ৬৫ কেজি আলু রাখা যায়।

'কীভাবে ক্ষতি পোষাবো এবং পরে চাষের প্রস্তুতি নেবো জানি না', বলেন নজরুল।

একই এলাকার কৃষক নির্মল চন্দ্র চলতি মৌসুমে ১৮০ বিঘায় আলু চাষ করেছেন।

তিনি জানান, ১০ হাজার বস্তা আলু হিমাগারে রাখার ইচ্ছা থাকলেও মাত্র এক হাজার ৭০০ বস্তা রাখতে পেরেছেন।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার পুরিয়া গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি এক হাজার বস্তার পরিবর্তে মাত্র ৩০০ বস্তা আলু হিমাগারে রাখতে পেরেছেন।

সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও ও এর আশপাশের জেলায় রাস্তায় পচা আলু পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুর জেলা কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন ডেইলি স্টারকে জানান, গত মৌসুমে আলু চাষে ভালো আয় হওয়ায় এবার চাষিরা বেশি আলু রোপণ করেছিলেন।

তিনি বলেন, 'কৃষকদের সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে যতটা সম্ভব আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছি।'

মুন্সীগঞ্জ সদরের কৃষক আশরাফ সরকার চলতি মৌসুমে ১১৫ শতক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন।

তিনি বলেন, 'প্রতি কেজি আলুতে ২৫ টাকা খরচ হয়েছে। বিক্রি না হওয়ায় হিমাগারে রেখেছি। হিমাগারের খরচসহ প্রতি কেজির দাম বাড়বে ৩২ টাকা। এখন দাম এতটাই কমেছে যে, খরচের অর্ধেকও তুলতে পারব না।'

মুন্সীগঞ্জের মুন্সিরহাটের পাইকারি বিক্রেতা পাপ্পু সাহা ডেইলি স্টারকে জানান, চাষিরা আলু বিক্রির জন্য দোকানে রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু দাম আরও কমেছে, তাই বিক্রিও কমেছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ মুসলিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় চাষিরা প্রয়োজন অনুযায়ী আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না।'

'ফলে যে দাম পাওয়া যায় তাতেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। এ কারণে বাজারে সরবরাহ বেড়ে দাম আরও কমছে।'

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে ৩৬৫টি হিমাগারে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লাখ টন আলু মজুদ করা হয়েছে।'

তিনি বলেন, হিমাগার ও নিয়মিত ভোগ সত্ত্বেও আলুর একটি বড় উদ্বৃত্ত সাপ্লাই চেইনে রয়ে গেছে। ফলে অনেক কৃষক এখনও তাদের উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। অন্যদিকে, সংরক্ষণের পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে আলুর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পচে যাচ্ছে।

বাবু আরও বলেন, দেশের আলুর প্রকৃত চাহিদা সম্পর্কে সরকারের কাছে সঠিক তথ্য নেই। ফলে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। চাষিরা ভরা মৌসুমে আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন।

তার মতে, উৎপাদন ও হিমাগারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

 

Comments

The Daily Star  | English

Four of a family killed in Sylhet hillock collapse

The incident occurred around 2:00am in Bakhtiarghat area under Lakshanaband Union of Golapganj upazila

20m ago