আলু খেয়ে পয়সা বাঁচানো কালু মিয়াদের কী হবে

দেশের বাজারে তেল-পেঁয়াজ-আদা-কাঁচামরিচ ও ডিমের পর এখন দামের গরম দেখাচ্ছে 'সস্তার সবজি' হিসেবে পরিচিত আলু। ভরা শীতেও এর উত্তাপ না কমে যেভাবে আরও বেশি গনগনে হয়ে উঠছে তাতে এই 'নিরীহ' সবজির গায়ে হাত দেওয়াই দায়।
দুর্মূল্যের বাজারে নিম্ন আয়ের ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর দৈনিক খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রেও আলুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার ফাইল ফটো

দেশের বাজারে তেল-পেঁয়াজ-আদা-কাঁচামরিচ ও ডিমের পর এখন দামের গরম দেখাচ্ছে 'সস্তার সবজি' হিসেবে পরিচিত আলু। ভরা শীতেও এর উত্তাপ না কমে যেভাবে আরও বেশি গনগনে হয়ে উঠছে তাতে এই 'নিরীহ' সবজির গায়ে হাত দেওয়াই দায়।

ভাত না হলে বাঙালির চলে না। আবার ভাতখেকো বাঙালির আলুর ওপর নির্ভরশীলতা খুব যে কম, সেটাও বলা যাবে না।

পৃথিবীর মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভুট্টা, গম আর চালের পরই আলুর অবস্থান। বিশ্বের অনেক দেশেই রুটি বা ভাতের বদলে আলু খাওয়ার প্রচলন আছে। তবে আমাদের দেশে আলু এখনো পরিপূরক বা সহায়ক খাবার। ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা বা তরকারিতে আলু না হলে যেন চলে না। আর দুর্মূল্যের বাজারে নিম্ন আয়ের ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর দৈনিক খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রেও আলুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

তাই বোধকরি বঙ্গসংস্কৃতি ও এর ভাষাতেও আছে আলুর প্রভাব। যেমন—'রেল গাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম' ছড়াটি জানে না এমন কথা বলা শিশু পাওয়া দুষ্কর। আবার নাদুসনুদুস দেখতে কাউকে লোকে আদর করে 'আলু' বলেও ডাকে। সুযোগসন্ধানী কিংবা সবার মন জুগিয়ে চলায় ওস্তাদ কারোর ক্ষেত্রেও আলুর উদাহরণ টানা হয়। অন্যদিকে কারও 'আলুর দোষ' মানেই হলো, তার চরিত্রের আর কিছু বাকি থাকল না।

ভরা শীতেও আলুর উত্তাপ না কমে তা আরও বেশি গনগনে হয়ে উঠছে। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার ফাইল ফটো

এমন পরিস্থিতিতে আলুর দামের দাদাগিরিতে নিদারুণ বিপাকে পড়া পুরো জনগাষ্ঠীর ভেতর কালু মিয়ার অবস্থাটা বোধ করি একটু বেশিই সঙ্গিন। কারণ আলু খেয়ে যে পয়সা জমানো যায়—পুরো জাতিকে সেই পথ তিনিই দেখিয়েছিলেন।

গত শতকের আশির শেষ কিংবা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিটিভিতে প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে এখনকার জনপ্রিয় উপস্থাপক, নির্মাতা ও অভিনেতা হানিফ সংকেতকে গাইতে দেখা যায়, 'কালু মিয়া আলু খাইয়া পয়সা জমাইছে/তালি দিয়া জামা পিন্দা খরচা কমাইছে'।

গানের কথাতেই বোঝা যায়, কালু মিয়া একজন হাড়কিপটে মানুষ। তাই চাল কেনার খরচ বাঁচিয়ে সস্তার আলু দিয়েই কর্মসমাধা করতে চেয়েছিলেন তিনি।

কালু মিয়ার এই গানটি তখন ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল। তাই এখনকার বাস্তবতায় ওই গানের কথাগুলো আবার কারও মনে পড়তেই পারে।

নব্বইয়ের দশকে সাধারণ মানুষের ভেতর আলু খাওয়ার অভ্যাস বাড়াতে ও আলু নিয়ে নেতিবাচক ধারণা দূর করতে সরকারি বিজ্ঞাপনটিও ছিল চোখে পড়ার মতো। জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যায়ের বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার আকারে সাঁটানো সেই বিজ্ঞাপনে দেখা যেত, ‍পোস্টারের প্রায় পুরোটাজুড়ে ভুড়ি উপচে পড়া এক লোকের ক্যারিকেচার। পাশে লেখা, 'আলু খেলে ভুড়ি হয়, এ কথাটি সত্য নয়।'

আলুর দাম
সব ধরনের মোটা ও মাঝারি চালের চেয়ে আলুর দামই এখন বেশি। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার ফাইল ফটো

সর্বশেষ নতুন সহস্রাব্দে এসে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এখনকার মতোই নৈরাজ্যের বাজারে ভাতের ওপর চাপ কমিয়ে আলু খাওয়া বাড়ানোর জন্য যে রোড-শো করা হয়েছিল দেশজুড়ে, সেই স্মৃতি এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ভোলার কথা নয়।

ওই প্রচারণার স্লোগানটিও ছিল ছড়ায় ছড়ায়—'বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান'।

কিন্তু কথা হচ্ছে, বিদ্যমান বাজার বাস্তবতায় আলু খেয়ে ভাতের ওপর চাপ কমানোর কোনো সুযোগ নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এখন বেশির ভাগ চালের চেয়ে আলু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে মোটা ও মাঝারি ধরনের চালের দামকে ছাড়িয়ে গেছে নতুন-পুরোনো আলুর দাম। ক্ষেত্রবিশেষে সরু চালের দামকেও অতিক্রম করেছে সস্তার আলু।

অথচ মৌসুম শুরু হওয়ার পর বাজারে নতুন আলু এসেছে। কিছু পুরোনো আলুও এখনো বাজারে আছে। তবু আলুর দাম কমছে না।

গতকাল শনিবারও ঢাকার কয়েকটি বাজারে প্রতি কেজি নতুন ও পুরোনো আলু ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

আলুর দাম
ভাতখেকো বাঙালির আলুর ওপর নির্ভরশীলতা খুব যে কম, সেটাও বলা যাবে না। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার ফাইল ফটো

বিক্রেতাদের ভাষ্য, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিতে বেড়েছ অন্তত ১০ টাকা। গত বছরের এই সময়ে তারা নতুন আলু বিক্রি করেছেন ২০-২২ টাকা কেজি দরে। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে সেই আলুর দাম কীভাবে ৮০ টাকায় উঠতে পারে এর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। ফলে বিরক্ত-হতাশ-ক্ষুব্ধ-হতভম্ভ ক্রেতাদের ন্যুনতম সান্ত্বনা পাওয়ারও উপায় থাকছে না।

অথচ বাজারে নতুন আলু আসার পর সাধারণত পুরান আলুর দাম পড়ে যায়। কিন্তু এ বছরের আলুর বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন।

এর বিপরীতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে এখন প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮-৫০ টাকা। মাঝারি চাল পাওয়া যাচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। আর প্রতি কেজি সরু চালের দাম পড়ছে ৬০-৭৫ টাকার মধ্যে।

ফলে সব ধরনের মোটা ও মাঝারি চালের চেয়ে আলুর দামই এখন বেশি।

সুতরাং একটা সময় দেশে মানুষকে ভাতের বিকল্প হিসেবে আলু খাওয়ার যে পরামর্শ দেওয়া হতো, কিংবা কালু মিয়াদের মতো অনেকে খরচ বাঁচাতে কিংবা চাল কেনার সাধ্য না থাকায় বাধ্য হয়ে যে আলু খেতেন, সেই সুযোগ আর থাকছে না।

তাই বিদ্যমান বাস্তবতায় এমন স্লোগান তো হতেই পারে—'বেশি করে মুলা খান, আলুর ওপর চাপ কমান।' কারণ মুলাই এখন বাজারের সবচেয়ে সস্তা সবজি; যদিও তা ভাতের বিকল্প না।

আলুর দাম
স্টার ফাইল ফটো/রাশেদ সুমন

সোনা-আলু সমানে সমান

এই উপশিরোনামের সঙ্গে অবশ্য বর্তমান বাস্তবতার মিল থাকার কথা না। তবে আলুর দামের রেকর্ডের মতোই গত সপ্তাহে দেশে প্রতি ভরি সোনার দামেও রেকর্ড হয়েছে।

এখন সোনা আর আলু কীভাবে এক কাতারে এসেছিল সেই গল্পে ফেরা যাক।

ইতিহাস বলছে—১৮৯৬ সালে তিন স্বর্ণসন্ধানী জর্জ কারম্যাক, ডসন চার্লি ও স্কুকুম জিম ম্যাসন কানাডার ডসন শহর লাগোয়া ক্লোনডাইক নদীতে সোনার খোঁজ পান। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে স্বর্ণসন্ধানীরা শহরটিতে ভিড় করতে থাকেন। দুই বছরের ব্যবধানে সেখানকার জনসংখ্যা দেড় হাজার থেকে ৩০ হাজারে পৌঁছায়।

ইতিহাসে এই ঘটনা 'ক্লোনডাইক গোল্ড রাশ' নামে পরিচিত। কথিত আছে, সে সময় পুষ্টিকর খাবার হিসেবে আলু এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে স্বর্ণসন্ধানীরা আলু কিনতেন সোনার বিনিময়ে।

আবার প্রথম মহাকাশচারী সবজি হিসেবেও আলু আলাদা একটা ইজ্জত আছে। মহাকাশে দীর্ঘ ভ্রমণে যেন নভোচারীদের খাবারের সমস্যা না হয়, সে জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ১৯৯৫ সালে স্পেস শাটল কলম্বিয়া অভিযানে চাষের জন্য মহাকাশে আলু নিয়ে যাওয়া হয়।

পুষ্টিবিদরা বলে থাকেন, শুধু আলু খেয়েও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। আলুর সঙ্গে কেবল দুধ কিংবা মাখন খেলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। একটি মাঝারি আকারের আলুতে থাকে ১১০ ক্যালরি। এক কাপ ভাতে থাকে ২২৫ ক্যালরি।

আলুর দাম
সে সময় পুষ্টিকর খাবার হিসেবে আলু এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে স্বর্ণসন্ধানীরা আলু কিনতেন সোনার বিনিময়ে। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

ভদকার মতো কিছু অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় তৈরিতেও আলু ব্যবহার করা হয়।

আবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মগুলোর একটি আঁকা হয়েছে আলু নিয়ে। নাম 'দ্য পটেটো ইটার্স'। ভ্যান গগের আঁকা এই তৈলচিত্রে এক কৃষক পরিবারের পাঁচ সদস্যকে একসঙ্গে বসে আলু খেতে দেখা যায়।

অনুজ্জ্বল আলোর এই ছবিটি সম্পর্কে ভ্যান গগ নিজেই এক চিঠিতে বলেছিলেন, নামকরণের সার্থকতা ধরে রাখতে ছবির চরিত্রগুলোকেও তিনি এমনভাবে আঁকেন যাতে তাদের দেখতে ধুলোমাখা আলুর মতোই মনে হয়, যে আলুর খোসা ছাড়ানো হয়নি।

বিখ্যাত এই তৈলচিত্রটি সংরক্ষিত আছে আমস্টারডামের ভ্যান গগ জাদুঘরে। প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৮৫ সালে আঁকা এই চিত্রকর্মের রেপ্লিকা দেখেই বোঝা যায়, ছবির ওই কৃষক চরিত্রগুলোর সঙ্গে শ্রমে-ঘামে-অপুষ্টিতে মলিন হয়ে থাকা বাংলাদেশের কৃষকদের খুব অমিল নেই। রক্ত পানি করে উৎপাদিত আলু ও অন্যান্য ফসলের ন্যায্য মূল্য এই কৃষকরা কোনকালেই পান না। লাভের গুড় খেয়ে যায় ফড়িয়া আর সিন্ডিকেটের ভূত। আর দ্রব্যমূল্যের স্টিমরোলারে পিষ্ট হয় নিচু তলার মানুষ।

রূপকধর্মী কথাকার আবু ইসহাকের বিখ্যাত 'জোঁক' গল্পটি একসময় মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত ছিল। গল্পের শুরুটা এ রকম- 'সেদ্ধ মিষ্টি আলুর কয়েক টুকরা পেটে জামিন দেয় ওসমান। ভাতের অভাবে অন্য কিছু দিয়ে উদরপূর্তির নাম পেটে জামিন দেওয়া। চাল যখন দুর্মূল্য তখন এ ছাড়া উপায় কী?'

সেই সেপ্টেম্বর মাস থেকেই আলুর বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে হিমাগারভিত্তিক সিন্ডিকেটের হাতে। আরও অনেক নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটের মতো এই সিন্ডিকেট ভাঙতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। কিংবা এ ধরনের সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার আদৌ আন্তরিক কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

এমন পরিস্থিতিতে এই যুগের ওসমানরা এখন পেটে জামিন দেবেন কী দিয়ে?

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago