পুরান ঢাকার বিয়ের খাবারের একাল-সেকাল

পুরান ঢাকার বিয়ে

পুরান ঢাকায় বিয়েশাদির মতো বিশেষ আনন্দমুখর অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ আগে ছিল পোলাও-মাংস। আজকাল অবশ্য কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনাই করা যায় না।

তবে একটু অতীতে ফিরে গেলে মনে পড়বে জাফরানি মোরগ পোলাওয়ের সুঘ্রাণ আর স্বাদ। জাফরানি মোরগ পোলাও থেকে খাসির বিরিয়ানি- কীভাবে পুরান ঢাকার স্বাদে বিরাট এই পরিবর্তন এলো তা নিয়েই জানব। পুরান ঢাকার বিয়ের খাবারের স্বাদ, পরিবার, আরও অনেক কিছু নিয়ে গল্প হবে আজ।

স্বাদের ইতিহাস

চকবাজার থেকে জেল রোড ধরে আট মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন আমাদের গন্তব্যে- ৪৮, আবুল হাসনাত রোড। এই বাড়ির বাসিন্দা খ্যাতিমান সৈয়দ পরিবার। পুরান ঢাকায় ঘটে যাওয়া সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের নীরব সাক্ষী এই পরিবার, কারণ তারা তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে একই ঠিকানায় বসবাস করে আসছেন।

এই পরিবারের সদস্য খাদ্যরসিক সৈয়দ আহমেদ আলী বলেন, 'যদি বিয়ের খাবারের কথা বলেন, তবে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে এখন বিভিন্ন রীতিনীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে এবং এখন আর একচেটিয়া কোনো ''ঢাকাইয়া মেনু'' নেই। অথচ পাঁচ দশক আগেও কিন্তু এমনটা ছিল না।'

তিনি আরও বলেন, 'সত্যি বলতে, কিছু প্রথা এখনো বেশ বহাল তবিয়তে রয়েছে। কিন্তু খাবারের পাতে দিন শেষে কাচ্চি, চিকেন রোস্ট আর রেজালাই রাজত্ব করে এখন।'

পুরান ঢাকার বিয়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে খাবারের ব্যাপারটি ভীষণ গভীরভাবে জড়িত।

উৎসবের এলাকা, খাবারের রাজত্ব

বংশালের জাহানারা ফাউন্ডেশন মিউজিয়ামের সভাপতি জিনাত পারভীন দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাইয়া জীবনযাত্রা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।

তিনি বলেন, 'পুরান ঢাকার মানুষের জন্য বিয়ে একটি বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। শুরুটা হয় পানচিনি, জামাই খাওন, বলাবলি এবং সবশেষে বিয়ের মাধ্যমে। এরপরেও থাকে একের পর এক অনুষ্ঠান। যেমন বউভাত, ফিরানি ইত্যাদি।'

তিনি আরও যোগ করেন, 'এক সময় এসব প্রতিটি অনুষ্ঠানেরই ছিল নিজস্ব স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও নিজেদের নানা আচার অনুষ্ঠান। আজও মূল বিয়ের আগে পানচিনি বা বাত পাকার মত অনুষ্ঠান পুরান ঢাকার বিয়েতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।'

মুসলিম বিয়েতে, এই দিনটি মোহরানা (বিয়ের দেনমোহর) নির্ধারণের জন্য আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আলোচনাগুলো থেকে বরকে দূরে রাখা হয় এবং বাত পাকা অনুষ্ঠানের ভোজ থেকে বঞ্চিত থাকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে 'জামাই খাওয়ানো' রীতির উদ্ভব ঘটে। কনের পরিবার বর, তার আত্মীয়-স্বজন এবং ঘনিষ্ঠ সদস্যদের জন্য খাবার পাঠায়। ঐতিহ্যগতভাবে, জামাই খাওয়ানোর জন্য পাঠানো খাবারের তালিকা অনেক লম্বা ও বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে এবং আজও কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি পর্যন্ত সব খাবার বহনের জন্য প্রায়ই ট্রাকের প্রয়োজন হয়!

যদিও এই আচার-অনুষ্ঠানের জাঁকজমক আর বিলাসিতা ঢাকাবাসীর কাছে এক প্রিয় রীতি হিসেবে রয়ে গেছে, তবুও এর অতিরঞ্জিত ব্যয়বহুলতা এখনো কিছু প্রশ্ন তোলে। জামাই খাওয়ানোর এই রীতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি আধুনিক সময়ের বাস্তবতার সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি।

মুরগির বিশেষ কদর

বেশিরভাগ মানুষ এটি জেনে অবাক হবেন যে, ঢাকাইয়াদের বিয়ের ঐতিহ্যবাহী খাবারে গরু বা খাসির মাংস নয়, বরং মুরগি ব্যবহৃত হতো। মুরগির এই জনপ্রিয়তার রহস্য কী?

এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে মুঘল রান্নাঘরের গোপন রহস্যে। সেই সময় পোলাও রান্নার প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং বর্তমান ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের ঘরোয়া রান্না থেকে অনেকটাই আলাদা।

খাদ্য ইতিহাসবিদ সাদ উর রহমান তার বই 'ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি' তে মোরগ পোলাও রান্নার জটিল প্রক্রিয়ার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি উল্লেখ করেন, 'চারটি মুরগি ১৬ টুকরো করে কাটা হতো, যার সঙ্গে এক কেজি সূক্ষ্ম দানার চিনিগুঁড়া চাল মেশানো হতো। এরপর কিশমিশ, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, আলুবোখারা, ঘি, দুধের সর ও জাফরান দিয়ে একসঙ্গে ধীরে ধীরে রান্না করা হতো।'

এই ধৈর্য ও পরিশ্রমসাধ্য প্রস্তুতিই ছিল পুরান ঢাকার মোরগ পোলাওয়ের বিশেষত্ব।

তিনি আরও' বলেন, 'মাংস ও ভাত এমন নিখুঁতভাবে মেশানো হতো যে মাংস দানাগুলোর মাঝেও আলাদা করে চেনা যেত। ভাত ঘি শুষে নিয়ে এক ধরনের তেলতেলে অনুভূতি তৈরি করত, কিন্তু কখনোই চিটচিটে হতো না। চাপ দিলে তেল ছাড়ত।'

মুঘল মোরগ পোলাওতে কাঁচা মরিচ বা ঝাল মসলা ব্যবহার হতো না। এত সব জেনে সহজেই কল্পনা করা যায়, আমাদের আধুনিক রান্নাঘর থেকে যে পোলাও বের হয়, তা এক সময়ের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে পরিবেশিত আসল মোরগ পোলাওয়ের তুলনায় অনেকটাই ফিকে।

বিয়ের অনুষ্ঠানে একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা ছিল আর তা হলো বোরহানির পর কখনোই ফিরনি পরিবেশিত হতো না, বরং পরিবেশিত হতো জর্দা বা মুতাঞ্জন। জাফরানে ভেজানো সুগন্ধি চালে কাজু, কিসমিস, বাদাম, খোয়া মেশানো হতো এবং ওপরে থাকত রূপার তবক। একে আরো অসাধারণ করে তুলত হালকা মিষ্টি, মসলা দেওয়া মাংসের টুকরোগুলো।

কাচ্চি এবং অন্যান্য ঐতিহ্য
উৎসবের উপাদান হিসেবে পরিচিত হলেও, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে কাচ্চি বিরিয়ানি বিয়েবাড়ির মূল খাবার হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়।

জিনাত পারভীনের মতে, কাচ্চি বিরিয়ানি বেশ ভারী, আবার একইসঙ্গে সুস্বাদু খাবার হওয়ায় শীতকালীন উৎসবগুলোতে এর জুড়ি নেই। মধ্য এশীয় এই খাবারটি স্থানীয় শেফদের হাতে স্বাদের চূড়ায় পৌঁছে গেছে এবং আজ তা উষ্ণতা ও আভিজাত্যের প্রতীক।

তিনি বলেন, 'কাচ্চির দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে, এটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি খাবার। নরম খাসির মাংস, সুগন্ধি চাল এবং নিখুঁত মশলার মিশ্রণে তৈরি এই বিলাসবহুল খাবারটি দ্রুতই ঢাকা শহরের বিয়েবাড়ির অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে, যেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে লুকিয়ে থাকে ভোজনরসিকতা।'

বিয়ে নাকি ঠিক হয় স্বর্গে, আর বিয়ের মতো আনন্দময় অনুষ্ঠান বিশেষ করে বাঙালি বিয়ে ভালো খাবারের আয়োজন ছাড়া অসম্পূর্ণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রীতি-নীতি নদীর মতো বদলায়। একসময় যেখানে মুরগির রকমারি পদ ছিল বিয়ের মূল আকর্ষণ, আজ তার জায়গা নিয়েছে কাচ্চি। পুরান ঢাকার বিয়ের মেনুও বদলেছে। এক দশক আগেও কাচ্চির আগে নান রুটি ও সবজি পরিবেশন ছিল অকল্পনীয়, হয়তো ৫০ বছর পর এটাই হয়ে উঠবে বিয়ের প্রচলিত ধারা, যেটা নিয়ে তখন গল্প লেখা হবে।

ছবি: অর্কিড চাকমা

এই লেখাটি স্টার লাইফস্টাইল এবং গ্যেটে ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের যৌথ সহযোগিতায় লেখা হয়েছে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

Smaller in size, larger in intent

Finance Adviser Salehuddin Ahmed has offered both empathy and arithmetic in his budget speech, laying out a vision that puts people, not just projects, at the heart of economic policy.

9h ago