রংপুর অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের মাছ

মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০ বছর আগে এ অঞ্চলে ১০৮ জাতের মাছ পাওয়া যেত। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

রংপুর অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি ভাওয়াইয়া গান 'নয়া ডাঙ্গাতে মাছ উজাইছে হ্যাঙ্গা পাতায়া থইস'। প্রায় ৫০ বছর আগে গানটি রচিত হয়েছে। মূলত ১০৮ প্রকার দেশি জাতের মাছ নিয়ে এই গান লেখা হয়েছিল। কিন্তু গান থাকলেও ১০৮ প্রকারের মাছ আর মিলছে না।

মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০ বছর আগে এ অঞ্চলে ১০৮ জাতের মাছ পাওয়া যেত। তবে বর্তমানে ৩০-৩৫ জাতের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আর ৭৩-৭৮ জাতের মাছ ২০ বছরে হারিয়ে গেছে।

লালমনিরহাট জেলা মৎস্য বিভাগের মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে যে ৩০-৩৫ জাদের দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তার পরিমাণ অনেক কম। তুলনা করা হলে আগের চেয়ে মাত্র ১২-১৫ শতাংশ দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে।'

'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অধিকাংশ জলাশয় পানিশূন্য হয়ে পড়ায় মাছের বিচরণ ও বৃদ্ধি থেমে যাচ্ছে। এছাড়া কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় দূষিত হচ্ছে জলাশয়ের পানি। এতে দেশি মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া চায়না দুয়ারি জাল, মরণ জাল, কারেন্ট জাল ও রিং জাল দিয়ে মাছ শিকার করায় মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন হচ্ছে। মাছের বিড্রিং গ্রাউন্ডগুলো নষ্ট করা হয়েছে,' বলেন তিনি।

তার ভাষ্য, 'অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা কৃষকদের দেশি জাতের মাছচাষ করার পরামর্শ দিচ্ছি, কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। হাইব্রিড মাছের দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা সেদিকে ঝুঁকছেন।'

এই মৎস্য কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, 'এখন যেসব দেশি জাতের মাছ দেখা যাচ্ছে, এক যুগ পরে এগুলোও হয়তো দেখা যাবে না।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা আহসান কবির বুলু জানান, তাদের গ্রামের বিলে তিন একর আয়তনের একটি পুকুর আছে। কয়েকবছর আগে সেখানে সারাবছরই পানি থাকত। কিন্তু এখন বছরের অধিকাংশ সময় তা পানিশূন্য থাকছে। এতে পুকুরটিও শুকিয়ে যায়। এই বিলে আগে গ্রামের মানুষ সারা বছর দেশি মাছ পেতেন। এখন অনেক দেশি মাছ এখন দেখা যায় না।

'আগে পুকুর শুকিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ মণ দেশি মাছ ধরতাম। আর এখন পাচ্ছি তিন থেকে চার মণ,' বলেন তিনি।

জেলেরা জানান, জলাশয় বিলীন হওয়া ও দ্রুত বর্ধনশীল হাইব্রিড মাছের চাষ বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে স্থানীয় জাতের মাছ বিলুপ্তির পথে।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সিংগারডাবরি গ্রামের যতীন চন্দ্র দাস বলেন, মাত্র কয়েক বছর আগেও স্থানীয়রা অনেক দেশি জাতের মাছের পেতেন। কিন্তু এখন সেগুলো বিরল হয়ে উঠছে। এখন স্থানীয় মাছ ৬০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যেখানে মাত্র পাঁচ বছর আগে ২০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হত।

তিনি বলেন, 'দেশি জাতের মাছ ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।'

লালমনিরহাট শহরের বানিয়াপট্টি এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুশান্ত সরকার বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে খোঁজাখুঁজির পর তিনি ৫ হাজার ৫০০ টাকায় তিন কেজি চিতল মাছ কিনেছেন।

লালমনিরহাট শহরের গোশালা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী শ্যামল চন্দ্র রায় বলেন, 'স্থানীয় জাতের মাছের জন্য মানুষ আমার কাছে অগ্রিম টাকা দেন। তবে এই বাজারে চাহিদার মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ দেশি জাতের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। বাকিগুলো চালনি মাছ (চাষ করা হাইব্রিড জাতের)।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা পাড়ের নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, বর্তমানে বেশিরভাগ সরকারি মালিকানাধীন জলাশয় ইজারাদারদের কাছে লিজ দেওয়া হচ্ছে। যারা এসব জলাশয় লিজ নিচ্ছেন তারা বেশি লাভের জন্য চালানি মাছ চাষ করছেন। অন্যদিকে অনেক প্রাকৃতিক জলাশয় শুকিয়ে গেছে, ফলে স্থানীয় মাছ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সারডোব গ্রামের কৃষক সাবেদ আলী বলেন, গ্রামে সাত একর জমি জুড়ে পাঁচটি পুকুর রয়েছে। সেখানে তিনি দ্রুত বর্ধনশীল হাইব্রিড জাতের মাছ চাষ করেন এবং প্রতি বছর ভালো লাভ করেন।

'আমি স্থানীয় মাছ চাষ করি না, কারণ তাদের বৃদ্ধিতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া, এখন আর সহজে দেশি জাতের মাছের পোনা খুঁজে পাওয়া যায় না।'

Comments

The Daily Star  | English
G7 statement on Israel Iran war

Sirens sounded after missiles launched from Iran, says Israeli army

Trump to decide within two weeks on possible military involvement

13h ago