সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ: অতীতের ভূত ঝাড়তে ব্যর্থ নতুন খসড়া

নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশেও আগের কালো আইনগুলোর অনেক ধারা রয়ে গেছে, যেগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের অভিযোগে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছে।

২৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদিত এই অধ্যাদেশ সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ), ২০২৩ ও এর পূর্বসূরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ), ২০১৮-এর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ভিন্নমতাবলম্বী এবং সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে ডিএসএ।

এর পরবর্তী সংস্করণ, সিএসএতেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার মতো অনেক ধারা ছিল। তবে সেখানে কঠোর ও অজামিনযোগ্য কারাদণ্ড সরিয়ে ফেলা হয়।

আগের দুই আইনের মতো নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশও অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সার্বজনীন অধিকার হিসেবে উপেক্ষা করে।

অধ্যাদেশের খসড়ায় 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার' অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। আগের দুই আইনেও এই ধারা ছিল।

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) ‍ডিএসএ ট্র্যাকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৪৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ডিএসএর আওতায় আনা 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' সংক্রান্ত মামলাগুলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে।

গত বছর জাতিসংঘের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক আইরিন খান এই ধারা নিয়ে সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে চিঠি পাঠান।

সেখানে তিনি লিখেন, 'অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা এবং ধর্ম বা বিশ্বাসের জন্য বৈষম্য থেকে প্রতিটি ব্যক্তিকে রক্ষা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন। কিন্তু এই আইন ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুভূতির সমালোচনা নিষিদ্ধ করে না।'

সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের গ্রেপ্তারে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত মানহানির ধারাটি বাদ দেওয়া হয়েছে খসড়া অধ্যাদেশে। সেখানে এসেছে 'সাইবার বুলিং' নামে নতুন এক ধারা।

এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে কাউকে অপমান, হয়রানি, ব্ল্যাকমেইল বা হেয় করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। গালি বা আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করাও এই আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে।

এখানে আরও বলা হয়েছে, কোনো কনটেন্ট যদি কারও মানহানি বা মানসিক আঘাতের কারণ হয়, তবে তা এই আইনের আওতায় আসবে।

সিজিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডিএসএর আওতায় অভিযুক্ত পাঁচ হাজার ব্যক্তির প্রায় অর্ধেকই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার, সরকারি কর্মকর্তা বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমালোচনা করে পোস্ট দেওয়ায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন।

পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ডিএসএর আওতায় অভিযুক্ত প্রতি তিনজনে একজন এবং সিএসএর আওতায় প্রতি চারজনে একজন ছিলেন সাংবাদিক।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এবং ডিজিটাল অধিকার ও সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ সাইমুম রেজা তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাইবার বুলিংয়ের অস্পষ্ট শব্দচয়ন এবং একে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ ভবিষ্যতে এই ধারার অপব্যবহার ডেকে আনতে পারে। কারণ এখানে মানহানির ধারণাটিও আছে। অতএব, ধারাটি আরও সুস্পষ্ট করা উচিত।'

'এই খসড়া আইন সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ ও ক্ষতিকারক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব আমি বুঝি। তবে এসব বক্তব্যের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে আইনে উল্লেখ থাকা উচিত, যাতে এটি অন্যকিছুর সঙ্গে মিশে না যায় এবং অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি না করে।'

এই খসড়া আইনের আওতায় নজরদারি সংস্থা হিসেবে থাকবে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা। তারা জাতীয় সংহতি, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও বৈরিতা উসকে দেয় এমন যেকোনো কনটেন্টকে ব্লক করে দিতে পারবে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও কোনো কনটেন্ট ব্লক করার জন্য নিরাপত্তা সংস্থাকে অনুরোধ করতে পারবে।

রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, 'শিল্প সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের বেশ কিছু সুপারিশ খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক। আইসিটি বিভাগের আওতাধীন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কনটেন্ট ব্লক করার সুযোগ বাড়ানো হয়েছে, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে।'

প্রস্তাবিত আইনের আওতায় একটি জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠিত হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন সরকার প্রধান। এই কাউন্সিলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধানরা সদস্য হিসেবে থাকবেন।

এই কাউন্সিল সরাসরি নিরাপত্তা সংস্থাকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারবে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের নীতি উপদেষ্টা এবং অধ্যাদেশের অন্যতম রচয়িতা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, 'এ ধরনের ধারার অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগের ঝুঁকি থেকেই যায়।'

'আইনের বাস্তবায়ন যেন ভদ্রতা ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে হয়, সেটি নিশ্চিতে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হওয়াটা বেশ জরুরি,' যোগ করেন তিনি।

টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশীদ দিয়া বলেন, 'এই বিধানগুলো নজরদারি এবং আন্তঃসীমান্ত দমনকে বৈধতা দেয়, যা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।'

'সেন্সরশিপ, নজরদারি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ এবং আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দেওয়া ক্ষমতার মতো গঠনগত সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছে এই অধ্যাদেশ।'

তবে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব দাবি করেন, আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যথেষ্ট নিয়ম-কানুন রাখা হয়েছে খসড়াটিতে।

'এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরোয়ানা ছাড়াই কাউকে তল্লাশি ও গ্রেপ্তার করা যাবে। কিন্তু অভিযুক্তকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। যা গুমের মতো অপরাধ প্রতিরোধ করবে,' বলেন তৈয়্যব।

খসড়া অনুযায়ী, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতি আস্থার অভাব থাকলে তা আদালতকে জানাতে পারবেন অভিযুক্ত ব্যক্তি। পাশাপাশি, কোনো অভিযোগ বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার মতো কি না, তা নির্ধারণ করে দেবেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট।

আগের দুই আইনে কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সম্পৃক্ততা ছাড়াই কারো বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করা যেত এবং সব মামলাই আদালত পর্যন্ত গড়াত।

এই খসড়ায় সাইবারস্পেসে নারী ও শিশুদের বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

সাইবারস্পেসে যৌন হয়রানির জন্য এখন তিন বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

তৈয়্যব বলেন, 'ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দাবি করার একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছি আমরা। ক্ষতিপূরণের জন্য কোনো ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করা হয়নি। সাইবার ট্রাইব্যুনাল ক্ষতির পরিমাণের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারবে।'

খসড়ায় একটি ধারা অনুযায়ী, গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ এবং প্রতারণার জন্য ই-কমার্স ওয়েবসাইটগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এই অপরাধ অজামিনযোগ্য।

হ্যাকিং, তথ্য চুরি ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসের মতো মামলাগুলোর জন্যও জামিন দেওয়া হবে না।

অধ্যাদেশে অনুযায়ী, বেআইনিভাবে কোনো সিস্টেমে প্রবেশ করে দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি করলে, গুপ্তচরবৃত্তি বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তির স্বার্থসাধনের জন্য কাজ করলে তা 'সাইবার সন্ত্রাস' হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই অপরাধও অজামিনযোগ্য।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ক্রিপ্টোকারেন্সি এখনো নিষিদ্ধই থাকছে।

এই খসড়া অনুমোদনের আগে প্রকৃত অংশীজনদের সঙ্গে কোনো অর্থবহ আলোচনা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সমালোচকরা।

সাবহানাজ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কথা বলে আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে মন্তব্যের জন্য মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছে, অংশীজনদের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপে যায়নি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেনি।

Comments

The Daily Star  | English

Interim govt not taking action following white paper: Economists

The makers of the white paper criticised the government for increasing value-added tax

43m ago