‘কণ্ঠরোধী’ সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্তে ভুক্তভোগীদের স্বস্তি

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

ভুক্তভোগীদের কেউ কেবল তার ভিন্ন মতটাই প্রকাশ করেছিলেন। কেউ এঁকেছিলেন রাজনৈতিক কার্টুন। কেউবা অনলাইনে নিছক রসিকতা কিংবা ঠাট্টার ছলে কিছু কথা বলেছিলেন।

একটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিসরে এর সবগুলোই ছিলো তাদের সাধারণ, স্বভাবসিদ্ধ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এতটুকু প্রতিক্রিয়ার জেরেই তাদের প্রত্যেককেই কারাগারে যেতে হয়েছিল। অনেকের কপালে জুটেছিল তীব্র শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকে এভাবেই প্রথমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ও পরে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) ব্যবহার করে মত প্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল; যা কুখ্যাতি পেয়েছিল 'কালাকানুন' হিসেবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবির মধ্যে সব কালাকানুন বাতিল বা সংস্কারের দাবিও সামনে আসে।

এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরপত্তা আইন বাতিল করার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে তাতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এই আইনের শিকার ব্যক্তিরা।

এমন একজন হলেন ডিএসএ ভিকটিমস নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক নৌ-স্থপতি গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার। কেবল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ১০ মাস কারাগারে ছিলেন তিনি।

গোলাম মাহফুজ গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৮-১৯ সালে ব্যাপকভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছিল। এর প্রতিবাদে বিষয়টি নিয়ে সে সময় ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। এর জের ধরে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর র‌্যাবের একটি দল আমাকে আটক করে। তাদের অভিযোগ ছিল, আমি ওই বাহিনীর বিরুদ্ধে লিখেছি িএবং ক্রসফায়ারের তথ্য সংগ্রহ করছি।'

এই নৌ-স্থপতি যে পোস্টটি দিয়েছিলেন সেটা ছিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য। কিন্তু তার এই ব্যাখ্যা কাজে আসেনি। টানা সাতবার তার জামিন আবেদন বাতিল করা হয়।

গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার একা ছিলেন না।

২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিন হাজার ২০৮ জনের নাম উল্লেখ এবং দুই হাজার ৮০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের তথ্য অনুসারে, পরবর্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদলে করা সাইবার নিরাপত্তা আইনে আরও ৩৭২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এ পরিসংখ্যানে যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইল ও জালিয়াতির জন্য দায়ের করা মামলাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এই পাঁচ হাজারেরও বেশি অভিযুক্তের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের (২,৩০৮ জন) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সরকার, পদধারী বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা সমালোচনামূলক পোস্টের জন্য। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করায় ২১৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

এই আইনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাংবাদিক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্তদের প্রতি তিনজনের একজন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে আসামিদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন সাংবাদিক।

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের তথ্য অনুসারে, সংবাদ প্রকাশ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টের জন্য অন্তত ২২৭ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে।

আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আসামিদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলার আসামিদের অর্ধেকের বেশি রাজনীতিবিদ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন অযোগ্য বিধান দিয়ে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত'কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই অপরাধে অভিযুক্ত ৯৯ জনের মধ্যে ৪৪ শতাংশই ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে আটটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে অন্তত পাঁচ হাজার ৮১৮টি মামলা চলমান আছে।

এর মধ্যে এক হাজার ৩৪০টি মামলা 'কথা বলার অপরাধে'; যার মধ্যে ৮৭৯টি মামলা বিচারাধীন এবং ৪৬১টির তদন্ত চলছে।

২০২১ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় সরকারি ত্রাণ বিতরণে বৈষম্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার পর দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। দিদারুল বলেন, তাকে চোখ বেঁধে সাত ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পাঁচ মাস জেল খাটতে হয়েছে তাকে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালে কারাগারে মারা যান। এছাড়া কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সাংবাদিক তাসনিম খলিল, সাংবাদিক শাহেদ আলমসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে 'গুজব ছড়ানো ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার' অভিযোগ আনা হয়।

আবার মামলার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু পোস্টও করতে হয়নি।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ফেসবুকে একটি ওয়েবিনার উপস্থাপনা করার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, যেখানে অতিথি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন কিছু সমালোচনামূলক মন্তব্য করেন। মামলায় প্রবাসী দেলোয়ারকেও আসামি করা হয়।

খাদিজাতুল কুবরা কারাগারে ছিলেন প্রায় ১৫ মাস। জামিনের জন্য তাকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়। গতকাল ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় সেই 'অগ্নিপরীক্ষার' বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, এই মামলায় তার নিয়মিত পড়াশোনা ও জীবনের স্বাভাবিক গতিপথকে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করেছে।

খাদিজা এ আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্তকে ভুক্তভোগীদের জন্য একপ্রকার বিজয় বলে অভিহিত করেন। বলেন, 'আশা করব এ ধরনের সব আইন বাতিল করা হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Polls could be held by year end ‘at the earliest’: Yunus

Chief Adviser Muhammad Yunus has stated that the next general election in Bangladesh could be held at the end of this year at the earliest

1h ago