ব্যাটারিচালিত রিকশা

তারা পথ দেখালেন, এখন সরকারের পালা

বহু বহু বছর ধরে রাস্তায় চলা পায়ে-চালানো রিকশাগুলো নাম এখন 'বাংলা রিকশা'। চালকদের অনেকের মুখে এই পরিভাষা শোনা যায়। তারা নবাগত ব্যাটারিচালিত রিকশাকে ডাকেন 'অটো' নামে।

বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎচালিত বাহন রাস্তায় নামার পর থেকেই তেল-গ্যাসচালিত পরিবহন ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর ঢেউ বাংলাদেশের রাস্তাতেও এসে পড়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছোট-বড় কারখানায় মেকানিকরা তৈরি করছেন ব্যাটারি-রিকশা। দেখতে হয়তো তেমন দৃষ্টিনন্দন না। কিন্তু, এসব বাহন সাধারণ মানুষের চলাচলে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে।

মেকানিকরা মূলত কাজ করেন ঝুপড়ি কারখানায় বা বাড়িঘরের উঠানে বা ফাঁকা জায়গায়। তাদের অস্থায়ী কারখানাগুলোয় তৈরি অটোরিকশা-ভ্যানগুলো দামের দিক দিয়ে তুলনামূলক সস্তা। পাশাপাশি এসব বাহন পুরো জাতিকে দ্রুত চলাচলের পথ দেখিয়েছে।

এখন এসব তিন-চাকার অটোগুলোকে আরও নিরাপদ ও টেকসই করার দায়িত্ব সরকারের।

এই প্রযুক্তিকে আনুষ্ঠানিক করার প্রক্রিয়াটির সরকারি নাম 'নিয়মিতকরণ'।

নিয়মিতকরণে দেরি হলে কী হবে? কী হবে যদি দেখেন ব্যাটারি-রিকশায় রাস্তা সয়লাব হয়ে গেছে?

যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুসারে, দেশে প্রতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনার ১৫ শতাংশেরও বেশি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত দ্রুতগামী রিকশাগুলোর কারণে।

অন্যদিকে, ব্যাটারি-রিকশাগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে নিলে শুধু ঢাকাতেই শার্দুল ইসলামসহ অন্তত দুই লাখ চালকের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।

অনেকে হয়তো বলবেন—ওরা ভিক্ষা করুক। সমাজ কি ঘামে ভেজা চালকদের শ্রমের মূল্য দিতে চায়?

শার্দুল ইসলামের প্রসঙ্গে ফিরি। জীবন চালাতে তিনি প্রতিদিন রিকশা চালান। তীব্র কায়িক পরিশ্রম থেকে মুক্তি পেতে তিনি পায়ে চালানো রিকশা বদলিয়ে ব্যাটারি-রিকশা নিয়েছেন।
বদলে যাওয়া অর্থনীতি

রাজধানীর শাহবাগ ও আশপাশের এলাকায় রিকশা চালান ৩৫ বছর বয়সী শার্দুল ইসলাম। আট বছর আগে যখন তিনি আরও ছোট ছিলেন তখন তিনি পায়ে চালানো রিকশা দিয়ে পরিবারের জন্য তিনবেলা খাবার জোগাড়ে হিমশিম খেতেন।

নিজের চালানো রিকশায় বসে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন দিনে আয় করি ১২০০-১৫০০ টাকা। মালিককে দিতে হয় ৪৫০ টাকা। এর মধ্যে ৬০ টাকা ব্যাটারি চার্জ। কখনো কখনো ছোটখাটো মেরামতের জন্য ১০০-১৫০ টাকাও দিতে হয়।'

'প্রতিদিন ৮০০-৯০০ টাকা ঘরে নিয়ে ফিরি। বৃষ্টি বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় আয় কম হয়।'

এই বদলে যাওয়া অর্থনীতি দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও সুযোগের এক জটিল সমীকরণের ইঙ্গিত দেয়।

পায়ে-চালানো রিকশা মালিকরা সাধারণত দৈনিক ১০০-১৫০ টাকা জমা খরচ দেন। শরীরে কুলায় না বলে চালকরা বেশিক্ষণ রিকশা টানতে পারেন না। আয়ও যায় কমে।

ব্যাটারি-রিকশা নতুন আর্থিক চিত্র তুলে ধরেছে। দৈনিক জমা খরচ ৪৫০-৫০০ টাকা। তেমন কায়িক পরিশ্রম না থাকায় তারা দীর্ঘ সময় রিকশা চালাতে পারেন।

শার্দুলের দুই মেয়েই কড়াইল বস্তিতে স্কুলে পড়ে। নিজের উপার্জনে তিনি তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে চান।

অন্যদিকে, রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় মোস্তাফিজ রহমান পায়ে-চালানো রিকশা দিয়ে আয় করেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানুষ এখন ব্যাটারি-রিকশা পছন্দ করে। দ্রুত যাওয়া যায়। ভাড়া করার সময় অনেক যাত্রী অটো খোঁজেন। কিছু রিকশায় বসার জায়গা অনেক। দুই জনের বেশি বসা যায়।'

'বেশি পরিশ্রম করে বাংলা-রিকশা চালালেও অটো থেকে আয় কম। অটো নেওয়ার কথা ভাবতেছি।'

প্রায় ১৫ বছর ধরে রিকশার মেকানিক রশিদ আহমেদ যুগের চাহিদা পরিবর্তনের কারণে এখন ব্যাটারি-রিকশার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।

তার ভাষ্য, 'বাংলা-রিকশায় এখন লাভ হয় না। মানুষ তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকে। দ্রুত চলে বলে তারা অটো পছন্দ করেন। ব্যাটারি-রিকশায় পরিশ্রম কম। দ্রুত যাওয়া-আসা করা যায়। ব্যাটারির দামও খুব বেশি না। বেশি প্যাসেঞ্জার নেওয়া যায়।'

কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্কের (ক্লিন) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাটারি-রিকশায় প্রতিদিন ৬৫৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। মোট সক্ষমতার আড়াই শতাংশ।

কম জ্বালানি খরচের কারণে সস্তায় চলাচলের মাধ্যম হিসেবে এই তিন চাকার বাহনগুলো প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটি মানুষকে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের সুবিধা দেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে—ব্যাটারি-রিকশা জাতীয় অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ৯৭ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার অবদান রাখছে। এরমধ্যে রিকশা তৈরির সাড়ে সাত কোটি টাকা, ব্যাটারির আট হাজার কোটি টাকা এবং যাতায়াত, রক্ষণাবেক্ষণ ও চার্জিং সেবার ৮২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা আছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় এসব গাড়ি তৈরি হচ্ছে। সরকারি লোকজনের অবদান নেই।'

'স্থানীয়রা দ্রুত চলাচলের গুরুত্ব বুঝেছেন। তারা নিজেরাই এসব বাহন তৈরি করেছেন। এখন এগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা হবে তা সরকারের ওপর নির্ভর করছে।'

তাদের গবেষণার কথা জানিয়ে হাসান মেহেদী আরও বলেন, 'দেশে আইসিই-নির্ভর ২০ শতাংশ যানবাহন যথাযথভাবে জ্বালানি খরচ করে। অথচ ব্যাটারি-রিকশার ক্ষেত্রে এই হার ৭৫-৮০ শতাংশ।'

দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ

সিরাজগঞ্জ থেকে পঁচিশ বছর বয়সী ইলিয়াস আমিনের ঢাকায় এসে জীবন-সংগ্রাম শুরু করাটা এত সহজ ছিল না। দারিদ্র্যের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার পর তিনি সেই কঠোর বাস্তবতায় পড়েন। গ্রামের অনেক তরুণ এমন বাস্তবতায় কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে চলে আসেন।

'পাঁচ বছর আগে যখন বাবা মারা যান, তখন মা ও বোনের দায়িত্ব নিতে হয়'—রিকশা চালানোর ফাঁকে মুখের মাস্কটি ঠিক করে নিয়ে ইলিয়াস বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা বলেন—'গ্রামে প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। একদিন ২০০ টাকা আয় করলে আরেকদিন বেকার থাকতে হয়।'

ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত তার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু, বিকল্প ছিল না।

রিকশা চালিয়ে ইলিয়াস এখন মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন। গ্রামে তা অসম্ভব। এই রোজগার শুধু তার জীবনকেই উন্নত করেনি, গ্রামে প্রভাব বাড়িয়ে দিয়েছে।

'বোন ক্লাস ফাইভে পড়ে। মার কাছে মাসে ১৫ হাজার টাকা পাঠাই। পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা জমাই। অবসরে অটো মেরামতের কাজ শিখি। আশা করি, দুই বছরের মধ্যে নিজে দোকান দিতে পারবো।'

নিবন্ধনহীন গাড়ি

ব্যাটারি-রিকশা ঘণ্টায় গড়ে ৩০ কিলোমিটার বেগে চলে। রাস্তায় রিকশার কাছাকাছি গতিতে নিবন্ধনহীন গাড়ি চলে না। এসব রিকশা ঢাকার যানজটে ঢুকতে দিলে ঝুঁকি বাড়বে। এগুলোর ফিটনেস-নিবন্ধন নেই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. শামসুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এসব বাহন বিশ্বের অন্যতম ধীরগতির শহর ঢাকায় চলাচলের জন্য একেবারেই উপযুক্ত না।'

ব্যাটারি-রিকশার কাঠামো, বিশেষ করে পায়ে চালানো রিকশায় ব্যাটারি বসিয়ে 'অটো' বানানোর কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এগুলো উচ্চগতির জন্য উপযুক্ত না। যেহেতু এসব বাহন বিআরটিএ নিয়ন্ত্রিত নয়, সেহেতু চালকরা প্রশিক্ষিত না। রাস্তায় নিয়ম মেনে চলাচলের জ্ঞানের অভাব আছে।'

শামসুল হক আরও বলেন, 'গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠে। গাড়িগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। যেহেতু অল্প দূরত্বের রাস্তার জন্য বা আবাসিক এলাকায় বাস চলে না, তাই এমন পরিস্থিতিতে এসব গাড়ি দরকার। তবে এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।'

ব্যাটারি-রিকশাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হিসেবে আখ্যা দিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বীকৃতির পাশাপাশি এর মূল্যায়ন করা উচিত। ব্যাটারি-রিকশা কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। যাতায়াতের সময় কমলে টাকাও বাঁচে।'

'দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষ এ খাতে জড়িত' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'কম-আয়ের মানুষদের কাজের সুযোগ করেছে। তাদের পরিবারে আয় বেড়েছে। জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করছে।'

'তবে এর দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে নীতিমালা তৈরি, সুস্পষ্ট স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ ও সিস্টেমের জন্য আলাদা নীতিমালা জরুরি।'

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারিগরি দিক থেকে রিকশা যান্ত্রিক বাহন নয়। মোটর বসালে যান্ত্রিক হয়ে যায়।'

'যান্ত্রিক বাহনের নিরাপত্তার বিষয়গুলো যদি এসব বাহনে সঠিকভাবে কাজ না করে তবে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দুর্ঘটনাও উদ্বেগের বিষয়। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে পরবর্তী উদ্যোগ নির্ধারণ করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Reforms vs election

Reforms vs election: A distracting debate

Those who place the election above reforms undervalue the vital need for the latter.

13h ago