বেকারদের জন্য বছরটি ভালো ছিল না
সদ্য পাস করা স্নাতকদের মুখ ফ্যাকাসে। অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই কেটেছে চলতি বছর। ২০২৪ সাল কেটেছে পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন, উপযুক্ত পদের জন্য আবেদন ও ঢাকায় নিয়োগ পরীক্ষায় উৎকণ্ঠা নিয়ে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন পুরোপুরি সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হওয়ার আগে গত জুন পর্যন্ত কিছুটা নিয়মিত সরকারি নিয়োগের মাধ্যমে বছরটি শুরু হয়েছিল।
তবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেকার নতুন স্নাতকদের সংখ্যার তুলনায় অনেক কম চাকরি দিয়েছে।
বছরজুড়ে ধীর অর্থনীতি, মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া, বেসরকারি খাতের ঋণ নেওয়া কমে যাওয়া, সরকার উৎখাত ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ফলে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের কারণে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠেছে।
সামগ্রিক অস্থিরতার মধ্যে ২০২৪ সালে চাকরির বাজার ভালো ছিল না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য বলছে, প্রায় ১০ লাখ বেকার স্নাতক নিয়ে বছরটি শুরু হয়েছে। দেশে সরকারি চাকরির হার প্রায় ছয় শতাংশ। বাকিদের বেসরকারি চাকরি খুঁজতে হয়।
২০২৪ সালে বৈশ্বিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ডলার সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো কারণগুলো চাকরির বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনাকে থামিয়ে দিয়েছে।
ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে আট দশমিক ৩০ শতাংশ। গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০২১ সালের মে মাসে করোনা মহামারির লকডাউনের সময় ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল সাত দশমিক ৫৫ শতাংশ।
এ ছাড়াও, জিডিপির শতকরা হিসাবে বেসরকারি বিনিয়োগ গত তিন বছর ধরে কমছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট কমে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় চাকরি খোঁজার ওয়েবসাইট বিডিজবস ডট কমের প্রধান নির্বাহী একেএম ফাহিম মাশরুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২৪ সালের প্রথমার্ধে কর্মী নিয়োগ স্থবির ছিল। গত দুই বছর ধরে এ ধারাই চলছে।'
'রাজনৈতিক অস্থিরতা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন নিয়োগকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে অক্টোবর থেকে নভেম্বরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।'
তার মতে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত থাকায় কর্মী নিয়োগ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
গত আগস্টে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
এর প্রভাব কিছুটা হলেও শ্রমবাজারে পড়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি বেক্সিমকো গ্রুপ গাজীপুরে তাদের ১৫ পোশাক কারখানার প্রায় ৪০ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছে।
গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেক্সিমকোর ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক লাভের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।
'আনুষ্ঠানিক চাকরি বাজার সংকুচিত হতে পারে'
জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২৪ সালে বিনিয়োগ ও উৎপাদন প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম।'
'ফলে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাবে।'
তিনি মনে করেন, সামগ্রিক কর্মসংস্থান ও বিশেষ করে যুব কর্মসংস্থানে খুব কমই কাজ হয়েছে।
সব মিলিয়ে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, বিশেষ করে উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে অনানুষ্ঠানিক ও কম বেতনের কাজ বা কৃষিতে যোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দীন ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে (জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগ) অনুপাত ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশে উন্নীত করার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে অব্যাহত অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার কারণে এই লক্ষ্য অর্জন অনিশ্চিত রয়ে গেছে।'
'বিস্ফোরণের অপেক্ষা'
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মূল্যায়ন করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া শ্বেতপত্র তৈরির প্যানেল কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজারের গতির মধ্যে অসামঞ্জস্যতাকে 'টিকিং টাইম বোম্ব' হিসেবে অভিহিত করেছে।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার আড়াই গুণ বেড়েছে। তাদের যোগ্যতার সঙ্গে শিল্প ও অর্থনীতির কাঠামোর অসামঞ্জস্যতার কারণে এমনটি হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে—শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও এই স্নাতকরা কম কারিগরি জ্ঞানের কারণে চাকরিবাজারের জন্য প্রস্তুত নয়।
গত ১২ বছরে স্নাতকদের সংখ্যা আড়াই গুণ বেড়েছে। ২০২২ সালে মোট শ্রমশক্তির প্রায় নয় শতাংশ।
বেকারত্বের হার ২০১০ সালের চার দশমিক নয় শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১২ শতাংশ হয়েছে।
আইএলওর বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনিশ্চিত চাকরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশেষ করে, শিক্ষিতদের জন্য।'
এমন পরিস্থিতি দূর করতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ও উচ্চতর কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে এমন খাতগুলোয় বিনিয়োগ বাড়ানোর সব চেষ্টাই করা উচিত।
Comments