পানামা, গ্রিনল্যান্ড ও কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্র বানাতে চান ট্রাম্প?
বেশ গুরুত্ব নিয়েই মার্কিন ভূখণ্ড বাড়ানোর কথা ভাবছেন সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পানামা খাল দখল করার ইচ্ছা প্রকাশের পর কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড নিয়েও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার সিএনএন সহ একাধিক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
গত সপ্তাহে তিনি কানাডার কর্মকর্তাদের জানান, যুক্তরাষ্ট্র তাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশীকে ৫১তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে নিতে পারে। পাশাপাশি তিনি পানামা খালের দখল ফিরিয়ে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। এরপর জানান গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার ইচ্ছার কথা।
যুক্তরাষ্ট্র এই খাল তৈরি করলেও প্রায় ২৫ বছর ধরে এর নিয়ন্ত্রণ মধ্য আমেরিকার দেশ পানামার হাতেই।
সবশেষ গত রোববার ট্রাম্প ডেনমার্কের তত্ত্বাবধানে স্বশাসিত দ্বীপরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড 'কিনে নেওয়ার' ইচ্ছা প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদেও তিনি এমন ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
প্রস্তাব না দরকষাকষির কৌশল?
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আবাসন ব্যবসায়ী থেকে রিপাবলিকান পার্টির নেতায় পরিণত হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কোনটি প্রকৃত অর্থে নীতিমালা সংক্রান্ত প্রস্তাব, কোনটি গণমাধ্যমের নজর কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ বা ভক্ত-সমর্থকদের চাঙ্গা করার কৌশলগত বক্তব্য—তা বুঝে ওঠা বেশ ঝামেলার।
এই ধারায়, সপ্তাহান্তে ট্রাম্পের সুয়েজ খাল দখল করে নেওয়ার হুমকির নেপথ্যে ছিল মার্কিন জাহাজের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্ক কমানোর দরকষাকষির অভিপ্রায়। প্রশান্ত থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে যাতায়াতের জন্য মার্কিন জাহাজগুলো অনেকাংশেই পানামা খালের ওপর নির্ভরশীল। এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে পানামা।
রোববার অ্যারিজোনায় রক্ষণশীল অধিকারকর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, 'আমি পানামার কর্মকর্তাদের বলছি, যা করতে চান তা বুঝেশুনে করবেন।'
রোববার সন্ধ্যায় ট্রাম্প মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্রের 'জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার' খাতিরে গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা নেওয়ার 'কোনো বিকল্প নেই'।
তিনি আরও জানান, কিছু মাদক ব্যবসায়ী চক্রকে তিনি 'বিদেশি জঙ্গি সংগঠন' হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে আগ্রহী। এই উদ্যোগ নিলে মেক্সিকোর ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনী পাঠানোর পথ সুগম হতে পারে। ট্রাম্প মাদক চক্রের নেতাদের নির্মূল করতে বিশেষ বাহিনী পাঠানো ও ফেনটানিল ল্যাবে বোমা হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছেন।
এ ধরনের উদ্যোগে মেক্সিকোর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে।
গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও পানামায় মর্কিন ভূখণ্ড সম্প্রসারণের ও মেক্সিকোয় হামলা চালানোর এসব উদ্যোগ নতুন প্রশাসনের বাস্তবসম্মত ইচ্ছার প্রতিফলন কী না, এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ট্রাম্পের ট্রানজিশন (রূপান্তর) টিম। সিএনএনকে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য ও সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট অনুসরণ করার উপদেশ দেন তারা।
পানামা খালের সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা
ট্রাম্পের এক উপদেষ্টা নাম না প্রকাশের শর্তে গণমাধ্যমকে জানান, পানামা খালের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত। পানামার ওপর চাপ দিয়ে জাহাজ চলাচলের শুল্ক কমাতে পারলে বিশেষ উপকার হতে পারে। চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বাড়তি শুল্কের কারণে সার্বিকভাবে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে পানামা খালের খরচ কমে গেলে শুল্কের ক্ষতি কমতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ক্ষমতা নিয়েই কানাডা, চীন ও মেক্সিকোর ওপর প্রচুর আমদানি শুল্ক আরোপের পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য প্রসঙ্গে ফ্লোরিডার রিপাবলিকান প্রতিনিধি কার্লোস জিমেনেজ বলেন, 'আমি সবসময়ই তার (ট্রাম্পের) কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিই। যদিও কখনো কখনো সেগুলো একটু অস্বাভাবিক শোনায়।'
তার মতে, 'জেনেবুঝেই পানামাকে তিনি হুমকি দিয়েছেন। একে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।'
ট্রাম্পের হুমকির প্রতিক্রিয়ায় পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো স্প্যানিশ ও ইংরেজি ভাষায় দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই খাল ও বন্দরের মালিকানা নিয়ে 'দরকষাকষি' হবে না।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তৈরি এই খাল ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের আমলে চুক্তির মাধ্যমে এর নিয়ন্ত্রণভার পানামার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই ঘটনাকে জিমি কার্টারের 'নির্বোধের মতো কাজ' বলে অভিহিত করেছেন ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট মুলিনো বলেন, 'স্পষ্ট করে বলতে চাই যে পানামা খাল ও সংলগ্ন এলাকার প্রতি বর্গমিটারের মালিক পানামা ও তা পানামার হাতেই থাকবে।'
তবে মুলিনোর বক্তব্য ট্রাম্প ও তার সহযোগীদের বিচলিত করতে পারেনি। মজার মজার ছবি ও মিম পোস্ট করে তারা বিষয়টিকে সামাজিক মাধ্যমে ট্রেন্ডিং করে তুলেছেন।
ট্রাম্প ট্রুথ সোশালে একটি ছবি পোস্ট করেছেন। এতে দেখা যায় পানামা খালে মার্কিন পতাকা উড়ছে। ছবির ক্যাপশন, 'যুক্তরাষ্ট্র খালে স্বাগতম'।
বিক্রি হবে না গ্রিনল্যান্ড
ডেনমার্কের আওতায় স্বশাসিত গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউট এগেদ গত সোমবার ফেসবুক পোস্টে বলেন, 'গ্রিনল্যান্ড আমাদের ভূখণ্ড। এটা বিক্রি হচ্ছে না বা ভবিষ্যতেও বিক্রি হবে না।'
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেত্তে ফ্রেদেরিকসেনের কার্যালয় থেকেও একই ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প এই প্রস্তাব রাখলে ডেনমার্ক একে 'অবাস্তব' বলেছিল।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, 'ডেনমার্ক নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। চলমান জটিল নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী সব দেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা খুবই জরুরি।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'গ্রিনল্যান্ড প্রসঙ্গে নতুন কিছু বলার নেই। গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশটি বিক্রির জন্য নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা সহযোগিতায় আগ্রহী। আমরাও এর সঙ্গে একমত।'
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে গ্রিনল্যান্ড 'কিনে নেওয়ার' ইচ্ছা প্রকাশ করেন ট্রাম্প।
সে সময় তিনি বলেছিলেন, 'কৌশলগত দিক দিয়ে এটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। আমি এর বাস্তবায়নে আগ্রহী। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলব। তবে অবশ্যই এই উদ্যোগ আমাদের প্রাধান্যের তালিকার এক নম্বরে নেই। এটুকু আমি নিশ্চিত করতে পারি।'
গত রোববার ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত হিসেবে উদ্যোক্তা কেন হাওয়ারির নাম প্রস্তাব করার সময় তিনি আবারও গ্রিনল্যান্ড কেনার কথা তুলেন।
কানাডার ব্যাপারে 'সিরিয়াস' নন ট্রাম্প
কানাডাকে ৫১তম অঙ্গরাজ্য করে নেওয়ার বিষয়টি মূলত দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রূডোকে 'খোঁচা' দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনটাই ভাবছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের বিলাসবহুল বাসভবনে নৈশভোজে অংশ নেন ট্রুডো। সেদিন থেকেই কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া নিয়ে একের পর এক 'ঠাট্টা' করে চলেছেন ট্রাম্প। মূলত সামাজিক মাধ্যমেই এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন ট্রাম্প।
সাম্প্রতিক এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, 'আমার মনে হয় এটা দারুণ হবে।'
তিনি কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ২৫ শতাংশ বাড়তি আমদানি শুল্ক আরোপের ঘোষণাও দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা ভাবছেন, এই শুল্ক নিয়ে দর কষাকষির অংশ হিসেবেই ট্রুডোকে এক হাত নিচ্ছেন ট্রাম্প।
যথারীতি ট্রাম্পের এসব উদ্যোগ সফল হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে মেক্সিকো ও কানাডার নেতা যথাক্রমে ক্লদিয়া শেনবম ও জাস্টিন ট্রুডো নবনির্বাচিত ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করার উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে মার্কিন সীমান্তে নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।
ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিম সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছে, 'এখনো ক্ষমতা গ্রহণ না করলেও ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ফেলেছেন বলা যায়।'
Comments