হেকিম হাবিবুর রহমান প্রসঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেডিও
হেকিম হাবিবুর রহমান বিশ শতকের প্রথমার্ধে পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী। তাঁর পুরো নাম শেফাউল-মুলক মওলানা হেকিম হাবিবুর রহমান খান আখুনযাদা। ইউনানি চিকিৎসাশাস্ত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ 'শেফাউলমুলক' ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত খেতাব, 'মওলানা' ধর্মীয় উপাধি, 'হেকিম' ইউনানি চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ডিগ্রি, 'আখুনযাদা' বংশীয় নাম।
'আখুনযাদা' বলতে বিশেষ একটি বংশকে বুঝানো হয়েছে। সম্ভবত এই পরিবারে বংশ পরম্পরায় শিক্ষাদীক্ষাদানের বিষয়টি চলে আসছিল। তাই পরিবারটি 'আখুনযাদা' নামে পরিচিতি লাভ করে। হেকিম হাবিবুর রহমান ঢাকার ছোট কাটরায় জন্মগ্রহণ করেন। তার অনন্য সাধারণ কর্ম ও প্রতিভার সংস্পর্শে উজ্জ্বল ও উর্বর হয়েছিল উপমহাদেশের ইউনানি চিকিৎসাশাস্ত্র, রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, ইতিহাস, সাংবাদিকতা প্রভৃতি বিষয়।
মানব ও সমাজসেবাকে তিনি আজীবন ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। পেশায় ছিলেন ইউনানি চিকিৎসক। ইউনানি চিকিৎসা সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'তিব্বিয়া হাবীবিয়া কলেজ'। হেকিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই শাস্ত্রের উন্নয়ন সাধনের জন্য ১৯৪০ সালে গড়ে তোলেন 'আঞ্জুমানে আতিব্বায়ে বাঙ্গাল ওয়া আসাম' (ইউনানি মেডিকেল এসোসিয়েশন বাংলা ও আসাম)। ইউনানি চিকিৎসা-পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো: নাড়িজ্ঞান অর্থাৎ নাড়ি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা।
এটি চিকিৎসা-বিজ্ঞানের কঠিনতম একটি অধ্যায়। এটি অর্জনের জন্য প্রচুর জ্ঞান, ব্যাপক অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ, তুলনামূলক পর্যালোচনা এবং নিরবচ্ছিন্ন সাধনা প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই নাড়ির গতি-প্রকৃতির মাধ্যমেই প্রায় সমুদয় রোগ-ব্যাধি নির্ণয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে হেকিম হাবিবুর রহমানের নাড়িজ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি অনেক সাধনার বলে নাড়িজ্ঞান আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সৈয়দ সুলায়মান নদবী হেকিম হাবিবুর রহমানের চিকিৎসা দক্ষতা সম্পর্কে ব্যক্তিগত একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে:
'কয়েক বছর আগে আমি একদিন রেডিওতে ভাষণ দিয়েছিলাম। হাকীম সাহেব তখন ঢাকা থেকে আমাকে লিখলেন: তিনি রেডিওতে আমার আওয়াজ শুনেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন যে, আমার হৃদপিণ্ড দুর্বল। তিনি আমাকে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিলেন। ব্যাপারটা তাই হলো কয়েকদিন পরেই আমি এ ধরনের একটি রোগে আক্রান্ত হলাম। আল্লাহ্ আমাকে সে রোগ থেকে নিস্তার দিয়েছেন।'
জাতিকে সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন করার লক্ষ্যে 'ঢাকা জাদুঘর' প্রতিষ্ঠায় পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তাছাড়া পৌর কমিশনার হিসেবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা পৌরসভার সকল কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। মহল্লার বিবাদ-বিসম্বাদ মিটান, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রতিরোধ করা, মহল্লায় মহল্লায় নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করা ইত্যাকার বহুমুখী জনসেবায় হেকিম হাবিবুর রহমান নিয়োজিত ছিলেন। মুসলিম জাতির জাগরণ ও উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে সমকালীন রাজনীতি ও শিক্ষা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁকে বাদ দিয়ে তদানীন্তন ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম রাজনীতি ও সংস্কৃতির কথা ভাবাই যেত না। তিনি ছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের সদস্য হয়ে তিনি শিক্ষার গুণগত মানবৃদ্ধিতে সহায়তা করেন। ভবিষৎ প্রজন্মের কথা ভেবে হেকিম হাবিবুর রহমান তাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত সংগ্রহ প্রায় তিন হাজারেরও বেশি বই ও ২২১টি দুর্লভ পাণ্ডুলিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে দান করেন যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের মূলভবনের নিচ তলায় 'হাকীম হাবীবুর রহমান কালেকশান' নামে ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান অর্জন ও গবেষকদের তথ্য-উপাত্ত্ব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাঁর সম্পাদিত 'আল-মাশরিক' (১৯০৬) ও 'জাদু' (১৯২৩) পত্রিকাদ্বয় পূর্ববাংলায় উর্দু সাংবাদিকতার গোড়াপত্তন করে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে তাঁর রচিত 'আসুদেগান-এ-ঢাকা' (১৯৪৬) ও 'ঢাকা আজ ছে পাচাশ্ বারস্ পহেলে' আমাদের জন্য ঐতিহাসিক দলিল।
'কয়েক বছর আগে আমি একদিন রেডিওতে ভাষণ দিয়েছিলাম। হাকীম সাহেব তখন ঢাকা থেকে আমাকে লিখলেন: তিনি রেডিওতে আমার আওয়াজ শুনেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন যে, আমার হৃদপিণ্ড দুর্বল। তিনি আমাকে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিলেন। ব্যাপারটা তাই হলো কয়েকদিন পরেই আমি এ ধরনের একটি রোগে আক্রান্ত হলাম। আল্লাহ্ আমাকে সে রোগ থেকে নিস্তার দিয়েছেন।'
যে গ্রন্থের জন্য হেকিম হাবিবুর রহমান ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গের জনমানুষের নিকট বিশেষভাবে পরিচিত সেটি হলো 'ঢাকা আজ ছে পাচাশ্ বরস্ পহেলে' তথা 'ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে'। এটি মূলতঃ ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে অলইন্ডিয়া রেডিও'র ঢাকা কেন্দ্র থেকে উর্দু ভাষায় প্রচারিত কথিকা সিরিজ। ১৯৪৫ সাল হতে পঞ্চাশ বছর পূর্বের অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকের ইতিহাস, সমাজ-সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে হেকিম হাবিবুর রহমানের নিজের প্রত্যক্ষ করা ঘটনার ধারাভাষ্য।
১৬ পর্বের এই কথিকার প্রথম পর্বের অনুষ্ঠানসূচি প্রকাশিত হয় ৭ জুলাই ১৯৪২ তারিখে। অনুষ্ঠান প্রচারের তারিখ ছিল ১৯ জুলাই (রবিবার), সন্ধ্যা ৭.৩০ ঘটিকায়। সেখানে 'DACCA FIFTY YEARS AGO' শিরোনামে লেখা ছিল, 'The Origin of the People of Dacca Talk in Hindustani by Shifa-ul-mulk Hakim Habibur Rahaman'। আর ১৬তম অর্থাৎ শেষ পর্বের অনুষ্ঠানসূচি প্রকাশিত হয় ০৭ আগস্ট ১৯৪৩ তারিখে। অনুষ্ঠান প্রচারের তারিখ ছিল ২৪ আগস্ট (মঙ্গলবার)। ২২ মার্চ ১৯৪৩ তারিখের ম্যাগাজিনে হেকিম হাবিবুর রহমানের একটি ছবি প্রকাশ পায়। শিরোনামে Dacca series 'DACCA FIFTY YEARS AGO' অনুষ্ঠানটির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়।
সর্বভারতীয় বেতার এ ঢাকা কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন হেকিম হাবিবুর রহমান। তখন পুরো ভারতবর্ষের সকল রেডিও স্টেশনের পাক্ষিক প্রোগ্রাম সিডিউল প্রকাশিত হতো 'The Indian Listener' নামক ম্যাগাজিনে। পাঠকের চিন্তার খোরাক হিসাবে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সে ম্যাগাজিনের কিছু প্রোগ্রাম সিডিউল এ নিবন্ধের সাথে সংযুক্ত করা হলো। এটির ১৯৩৯-১৯৪৫ সালের শতাধিক সংখ্যা পর্যালোচনায় দেখা যায়, 'DACCA FIFTY YEARS AGO' ছাড়াও হেকিম হাবিবুর রহমান এর বয়ানে 'KUCHH PURANI BATEN', 'THOUGHTS IN VERSES', 'OLD BUILDINGS OF DACCA', 'OLD MOSQUES OF DACCA' এর মতো বেশ কিছু কথিকা সিরিজ প্রচারিত হয়েছে।
এছাড়া শবে বরাত, মহররম ও ঈদ-উল আজহার মতো বিশেষ দিবসে তিনি SHAB-I-BARAT, MOHARRUM, ID-UZ-ZUHA শীর্ষক অনুষ্ঠানে শিল্পী হিসাবে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালের সংখ্যায় 'THE HOLY WORLD' শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানের শিল্পী হিসাবে হেকিম হাবিবুর রহমানের নাম উল্লেখ রয়েছে। একই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষক পণ্ডিত হেরম্ব নাথ তর্কতীর্থ। অনুষ্ঠানটি প্রচারের তারিখ ধার্য ছিল ১৬ ডিসেম্বর (শনিবার) ১৯৩৯। ঢাকা স্টেশনের যাত্রা হয়েছিল এ তারিখে। ১৯৩৯ সালের শেষ প্রান্তে এসে দিল্লি, বোম্বে, কলকাতা, লাহোর, লক্ষ্ণৌ, মাদ্রাজ, ত্রিচি ও ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসূচি প্রকাশ পেতো ইন্ডিয়ান লিসেনারে।
হেকিম হাবিবুর রহমানের বেতার অনুষ্ঠান সম্পর্কিত অজানা আরো কিছু বিষয়ের হদিস পাওয়া যায় ১৯৪৭ সালের জুন মাসে প্রকাশিত Islamic Culture (Volume XXI, No.3) (Page: 317-319) নামক ত্রৈমাসিক জার্নালে। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল In Memoriam। পাঠকের বোধগম্যতার জন্য জার্নালের সংশ্লিষ্ট অংশটি হুবহু তুলে ধরা হলো "Of his unpublished works namely (1) Masajid-I Dacca (Mosques of Dacca), (2) Shuarai Dacca (Poets of Dacca), (3) Thalatha Ghassala (a collection of Hakim Sahib's 16 radio talks on 'Dacca fifty years back', 20 radio talks on 'The Antiquities of Dacca' and 12 radio talks on 'The Historical Buildings of Dacca' and (4) Bengal's Contributions to the Arabic and the Persian Literatures, the last remains his masterpiece. These books when published are sure to throw a flood of light on the Islamic History, Culture and Civilization of India in general and Bengal in particular." এখানে 'Thalatha Ghassala' শব্দযুগলের ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন বোধ করছি।
এটি মূলতঃ কথ্য আরবি। ফারসি কবি হাফিজ শিরাজি ও পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবালের কাব্যে এই শব্দযুগলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। Thalatha অর্থ Three। আর Ghassala অর্থ Washerwomen। উল্লিখিত নিবন্ধটিতে 'The Antiquities of Dacca' সিরিজে যে ২০টি বেতার কথিকার উল্লেখ রয়েছে, সেটি অবশ্যই দ্য ইন্ডিয়ান লিসেনার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত 'KUCHH PURANI BATEN'। এ সিরিজের প্রথম সংখ্যাটির উল্লেখ পাওয়া যায় ২২ নভেম্বর ১৯৪৩ এবং ২০তম সংখ্যাটির দেখা মিলে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ তারিখ। ২২ নভেম্বর ১৯৪৩ তারিখের ম্যাগাজিন পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনুষ্ঠান প্রচারের তারিখ ও সময় নির্ধারিত ছিল ১১ ডিসেম্বর (শনিবার), সন্ধ্যা ৬.৪৫ মিনিটে। 'KUCHH PURANI BATEN' শিরোনামে সেখানে লেখা ছিল, Talk in Hindustani dwelling upon the old history of Dacca by Shefa-ul-Mulk Hakim Habibur Rahman Akhoonzada।
হেকিম হাবিবুর রহমান শুধু আমাদের এ উপমহাদেশেরই নন। বিশ্বের নানা দেশের ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের নিকট তিনি আরাধ্য। ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল রেকর্ড কমিশনের ডিসেম্বর-১৯২৯ ও ১৯৩০ এর মিটিং প্রসিডিংস-এ হেকিম হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে থাকা বেশ কিছু পাণ্ডুলিপির উল্লেখ রয়েছে। তার অপ্রকাশিত এসব গ্রন্থগুলোর সন্ধান পাওয়া সম্ভব হলে বিশেষত চল্লিশের দশকে সর্বভারতীয় বেতারে প্রচারিত তার কথিকাগুলো সংগ্রহ করা গেলে ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হবে।
Comments