অর্থনীতির শ্বেতপত্র তৈরির পেছনের গল্প

২০০৯ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে যে আর্থিক দুর্দশা দেখা দিয়েছে তা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরি করতে নিয়োজিত প্যানেলকে তিন মাস কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ২৯ আগস্ট প্রজ্ঞাপনে শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অব্যবস্থাপনার গভীরতা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা জানানো হয়। ১২ সদস্যের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলের তৈরি শ্বেতপত্রটি গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া হয়।

শ্বেতপত্রে অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এতে নব্যধনীদের উত্থান, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মিথ্যা বিবরণ দিতে ভুল তথ্য ও ব্যাপকহারে অর্থপাচারের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

ওই কমিটি ৬১৮ বার বৈঠক করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অংশীদারদের সঙ্গে ৬০ বার পরামর্শ করা হয়েছে। ২২টি নীতি-ভিত্তিক পরামর্শ, ১৭টি কারিগরি পরামর্শ, তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার ও ঢাকার বাইরে তিনটি গণশুনানি করা হয়।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিশটিংগুইশড ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে এর নানা দিক নিয়ে কথা বলেন।

'বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা সব বিষয় তুলে ধরতে এমন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ দেশবাসী ও অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিক নথির প্রয়োজন ছিল।'

'পুরো ব্যবস্থাটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। দেশে শক্তিশালী অর্থনীতির আখ্যান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ কারণেই শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা ভাবা হয়।'

'উত্তরাধিকার সূত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের পাওয়া অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে শ্বেতপত্রের ভাবনাটি আসে। সরকার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে যেসব সংকটে পড়বে তা চিহ্নিত করতে এটি করা হয়।'

পরিস্থিতি বোঝার জন্য স্বচ্ছতার চর্চা জরুরি।

'স্বচ্ছতার জন্য সবার জানা নেই এমন তথ্যসহ বিদ্যমান সব তথ্য দেখতে হয়। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলতে হয়।'

শ্বেতপত্র তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, 'শ্বেতপত্র এসেছে ব্রিটিশ ঐতিহ্য থেকে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে। যখন এমন পরিস্থিতি দেখা দেয় যার কোনো তাৎক্ষণিক বা সুস্পষ্ট সমাধান নেই, তখন বিশেষজ্ঞরা সমস্যাটি বিশ্লেষণ করে মতামত দেন। এখানে একটি মতামত থাকতে পারে, একাধিক মতামতও থাকতে পারে। বিষয়টি কমিটির ওপর নির্ভর করে।'

শ্বেতপত্রের সুবিধা হলো যে এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সংসদ বা সরকারে নির্দেশে হয়ে থাকে। কিন্তু যারা কমিটিতে থাকেন তারা স্বাধীনভাবে শ্বেতপত্র তৈরি করেন।

'এই শ্বেতপত্র সরকারের নির্দেশে হলেও তা সরকারের প্রতিবেদন নয়। প্রধান উপদেষ্টা আমাদেরকে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্ব দিলেও এটি তার প্রতিবেদন নয়। এটা কমিটির সদস্যদের প্রতিবেদন। এর জন্য তারাই দায়ী থাকবেন, সরকার নয়।'

তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন বলেন, 'সাংবাদিকসহ অনেক পাঠক অর্থনীতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখেন না। তাই তথ্য বিশ্লেষণের সময় বিভ্রান্তি দেখা দেয়।'

যেমন, শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলারের অবৈধ লেনদেন হয়েছে।

কেউ কেউ বলছেন—সংখ্যাটা এত বড় যে তা কীভাবে সত্যি হতে পারে? তারা বলছেন, সরকারের বার্ষিক বাজেটও এর চেয়ে কম।

'সমস্যা হলো—যারা এই ধরনের কথা বলেন, তাদের বোধগম্যতার অভাব আছে। অর্থনীতিবিদরা কখনই সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিয়ে কাজ করেন না; তারা আপেক্ষিক সংখ্যা নিয়ে কাজ করেন।'

'আমরা যা উল্লেখ করেছি তা জিডিপির মাত্র দুই দশমিক চার শতাংশ। কারো কারো কাছে এটি বড় সংখ্যা হতে পারে। কিন্তু বৈশ্বিক গড় তিন থেকে চার শতাংশ। এ বিষয়ে অনেকের ধারণা নেই। সমস্যা হলো আপনি বিষয়টির ব্যাখ্যা কিভাবে দিচ্ছেন।'

তিনি বলেন, 'আমরা ২২ পদ্মা সেতু ও ১৬ মেট্রোরেল করতে পারতাম। শিক্ষায় বর্তমান বরাদ্দ দ্বিগুণ করতে পারতাম। কালো টাকার কারণে এগুলো করা যায়নি।'

'অতীতে কী ঘটেছে তা শ্বেতপত্রে দেখানো হয়। একই সঙ্গে কেন তা ঘটল সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হয়। তবে কী করা দরকার সেদিকে কম নজর থাকে।'

তথ্যকেই মূল 'খলনায়ক' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'প্রবৃদ্ধি বেশি কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ খুবই কম। উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে কিন্তু কর আদায় হয়নি। উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় খুব কম টাকা খরচ হয়েছে। আমাদের কাজ ছিল এগুলোর কারণ বের করা।'

তিনি মনে করেন, 'উন্নয়নের আখ্যান কেবল গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ঘাটতিকেই তুলে ধরে। বিগত সরকার এ ধরনের গল্পের মাধ্যমে স্থানীয় ও বৈশ্বিক বৈধতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল।'

'যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে তাতে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'

'গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদ ছাড়া শুধু পছন্দসই ব্যবসায়ীদের গ্রুপ তৈরি করা হয়। সেই ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন পর রাজনীতিবিদ ও আমলায় পরিণত হন। তারা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। কিছুদিন পর তারা এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন যে, তারা নিজেরাই দেশ চালাতে শুরু করেন। তারপর তারা ক্লেপটোক্রেসি তৈরি করেন, যেখানে চোরেরাই শাসক।'

এই 'চোরেরা' শুধু একটি খাতে সীমাবদ্ধ থাকেননি; তারা জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), ও ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি বিদেশে বেনামি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় সক্রিয় ছিলেন।

'তারা ছিলেন অক্টোপাসের মতো। তারা শুধু বিচার বিভাগকেই প্রভাবিত করেনি, আইন প্রণয়নেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই ব্যবস্থার ফলে ব্যাংকিং আইন চোখের পলকে সংসদে পাস হয়।'

তারা বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, তাই বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের জায়গা ছিল না।

'বিপ্লব ছাড়া এ ধরনের বৈরী পরিবেশ দূর করা সম্ভব নয়।'

'রাজনীতি টেকসই না হলে সমাজও টেকসই হবে না' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করছে। আধুনিক সমাজে এটা কীভাবে সম্ভব? এই অসম প্রবৃদ্ধি চলতে পারে না।'

শ্বেতপত্র কমিটি গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করেছে বলে জানিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির অবমূল্যায়ন করায় আমরা মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানও দেখেছি। জ্বালানির দাম নির্ধারণ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র্যসহ অন্যান্য বিষয়গুলো দেখেছি। দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝাও খতিয়ে দেখেছি।'

তিনি বলেন, 'শ্বেতপত্র কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নয়। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। এটি বহু কিছুর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা গবেষণাপত্র। এখানে আর্থিক পরিস্থিতির ওপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।'

জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করার তাগিদ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে কিছু পরামর্শও দেন তিনি।

'অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছরের জন্য নেই। তবে অর্থনীতি ও বিনিয়োগ প্রতিদিনের অনুমানের ওপর ভিত্তিতে চলতে পারে না। প্রক্ষেপণটি দুই বছরের জন্য হওয়া উচিত।'

তিনি মনে করেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসতে দেরি করা উচিত নয়।

'রপ্তানি প্রণোদনা কমানো ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এতে বোঝা যায়, আমরা উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি।'

তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনা করার পরামর্শ দেন। কারণ উন্নয়নশীল দেশ হলে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা কমে যাবে।

তিনি মনে করেন, 'এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, ভারত ও চীনের মতো বাজার এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করা।'

'ঋণ ব্যবস্থাপনা টেকসই নয়; প্রতি বছর তা প্রায় এক বিলিয়ন। আমাদের ঋণ নিয়ে নতুন করে আলোচনা করতে হবে।'

শ্বেতপত্রের ব্যাপারে দেশ-বিদেশ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমেরও নজরে এসেছে।'

'এই শ্বেতপত্র তৈরিতে পরামর্শক খরচ বাবদ প্রায় ২৫ লাখ ডলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে একটি টাকাও নেওয়া হয়নি। বিনা পয়সায় তা করা হয়েছে।'

'কারণ দেশের জন্য কাজ করার এ এক অনন্য সময়।'

Comments

The Daily Star  | English
Gen Z factor in geopolitics

The Gen Z factor in geopolitics and the Bangladesh-US dynamics

Gen Z should keep in mind that the US cannot afford to overlook a partner like Bangladesh given the country’s pivotal position in South Asia’s economic landscape.

10h ago