গৌরব হারাচ্ছে মতিঝিল?
রাজধানী ঢাকার এক সময়ের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল যেন ঐতিহ্য হারিয়ে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। ফাঁকা অফিস ফ্লোরগুলো যেন সেই সংকটেরই প্রতিচ্ছবি।
মতিঝিলের পূবপ্রান্তে টিকাটুলি এলাকার ইত্তেফাক মোড় থেকে মতিঝিলের প্রাণকেন্দ্র শাপলা চত্বরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া দিলকুশা সড়ক ও সোজা পশ্চিমপ্রান্তের আরামবাগ-ফকিরের পুল ও নয়া পল্টন এলাকার কথা ধরা যেতে পারে। এখানে প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার একপাশে অন্তত ৪০টি বাণিজ্যিক ভবন। এগুলোর মধ্যে প্রায় ২২টিতে এখন 'টু-লেট' ঝুলছে। অথচ, এমন সময় ছিল যখন মতিঝিলে জায়গা পাওয়া ছিল 'অনেক টাকার' বিষয়।
ভাড়াটিয়াদের জন্য ভবনগুলোর বছরের পর বছর অপেক্ষা এই বাণিজ্যিককেন্দ্রের ক্ষয়িষ্ণু চিত্রই তুলে ধরে। একসময় রাজধানীর সবচেয়ে প্রাণবন্ত ব্যবসাকেন্দ্র এখন যেন প্রাণহীন।
অনেক বাণিজ্যিক ভবন গত পাঁচ বছর ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। নতুন ভাড়াটিয়া পায়নি। এ ছাড়াও, এখনো সেখানে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক আছে সেগুলো নতুন ঢাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী ও বারিধারার দিকে চলে যাচ্ছে।
নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মতিঝিলে শাখা রাখতেও নারাজ।
উদাহরণ হিসেবে মতিঝিলের আদমজী কোর্ট এনেক্স বিল্ডিং-২ এর কথা ধরা যায়।
একসময় ব্যাংকের কাছে ভাড়া দেওয়া এই ১২ তলা ভবনটি ছিল কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর।
২০২০ সালে করোনা মহামারির পর ব্যাংকটি পর্যায়ক্রমে এর প্রধান কার্যালয় গুলশানে সরিয়ে নেয়। এখন ভবনটির অধিকাংশই ফাঁকা। দিনের আলোতেও অন্ধকারাচ্ছন্ন।
আদমজী কোর্ট থেকে প্রায় ১৫ মিনিটের হাঁটা পথে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এনেক্স ভবনেও একই দৃশ্য। সম্প্রতি সেখানে দেখা যায়, ১১ তলা ভবনটি দুপুর ১টায় নিস্তব্ধ। লিফটে দু-তিনজনের দেখা মেলে।
কয়েক বছর আগেও তা ছিল কল্পনার বাইরে।
২০১০ এর দশকে যখন ভবনটিতে স্টক ব্রোকারেজ অফিস অনেক ছিল, তখন লিফটে উঠতে লাইনে দাঁড়াতে হতো। ১৯৫৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডিএসইর সব কাজ এখানে হতো।
শেয়ার লেনদেনের সময় ওই ভবনটির সামনে এত জনসমাগম হতো যে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় থাকতো না। এখন দিনের মাঝামাঝি সময়েও তা প্রায় জনশূন্য।
ঢাকার উত্তরাঞ্চল নিকুঞ্জে নিজস্ব ভবনে অফিস সরিয়ে নেওয়ার পর ডিএসইর পুরোনো ভবনটিতে হাজার হাজার বর্গফুট জায়গা খালি পড়ে আছে।
দুটি ব্রোকারেজ হাউস ও একটি বিমা প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে সরিয়ে নতুন জায়গায় নেওয়ার ঘোষণা গ্রাহকদের দিয়ে রেখেছে।
দিলকুশার সুদৃশ্য জীবন বীমা টাওয়ারেও একই চিত্র। ১৯৯০ এর দশক থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এখানে ছিল।
'সমস্যা হচ্ছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও নতুন প্রজন্মের অফিসগুলো এ এলাকায় আসছে না। ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি সচিবালয় কাছাকাছি হওয়ায় অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মতিঝিলে অফিস নিত।'
২০১৭ সালে বিএসইসি মধ্য ঢাকার শেরেবাংলা নগরে নিজস্ব ভবনে চলে আসার পর প্রায় ছয় হাজার ২০০ বর্গফুটের দুটি তলা এখন খালি।
এক সময় ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় ছিল মতিঝিলে। সেসময় এই বাণিজ্যকেন্দ্রের আধিপত্য ছিল দেশজুড়ে। এখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে অভিজাত গুলশান এলাকায়।
মতিঝিলের একাধিক ভবন মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কম ভাড়াতেও ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না।
মতিঝিলের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার এক ভবন মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একতলা খালি। চার বছর ধরে ভাড়াটিয়া পাচ্ছি না।'
নব্বইয়ের দশকে মতিঝিল অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ভাড়া ছিল এখানকার বাণিজ্যিক ভবনগুলোয়। এখন খুব কম মানুষই তাকে ফোন দিয়ে ভাড়ার খবর নেন।
তিনি বলেন, 'সমস্যা হচ্ছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও নতুন প্রজন্মের অফিসগুলো এ এলাকায় আসছে না। ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি সচিবালয় কাছাকাছি হওয়ায় অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মতিঝিলে অফিস নিত।'
মতিঝিলে সাধারণ বীমা করপোরেশনের একাধিক ভবন আছে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান, এখন তাদের ভবনগুলোর হাজার হাজার বর্গফুট ফাঁকা।
তাদের মতে, বছরের পর বছর ধরে মতিঝিলে ফ্লোর ফাঁকা থাকলেও ভাড়া কমেনি। তবে অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভাড়া বেড়েছে ধীরগতিতে।
অবস্থান ও সুযোগ-সুবিধা ভেদে এই এলাকায় প্রতি বর্গফুটের গড় ভাড়া ৬০ থেকে ৯০ টাকা।
গুলশান-বনানীর মতো এলাকায় বাণিজ্যিক ভবনগুলোর তুলনায় মতিঝিলে ভাড়া এখনো কম।
ভবন ভাড়া ও বিক্রির ওয়েবসাইট বিডিপ্রোপার্টি ডট কম থেকে জানা যায়, গুলশানে প্রতি বর্গফুটের গড় ভাড়া ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা। বনানীতে ৭০ থেকে ১৫০ টাকা।
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরে যাওয়ায় মতিঝিলের সিনেমা হলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মতিঝিলের টয়েনবি রোডে মধুমিতা সিনেমা হল একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। এখন দর্শকের অভাবে তা মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে।
মহামারির পর থেকে বন্ধ থাকা অভিসার সিনেমা হলের অবস্থা আরও খারাপ।
সিনেমা হলের পাশে অভিসার স্টোরের মালিক মো. লিটন ডেইলি স্টারকে জানান, নব্বইয়ের দশকে তিনি দোকান শুরু করেন। তখন তিনি ও তার তিন ভাই স্ন্যাকস বিক্রি করতেন।
একসময় হলের আশপাশে সিনেমা দেখার জন্য জড়ো হওয়া মানুষের ভিড় ছিল। সিনেমা ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে তার তিন ভাই অন্য কাজের খোঁজে দোকান ছেড়ে চলে যান।
মো. লিটন বলেন, 'এক সময় মানুষ সরকারি রেটের তুলনায় কালোবাজার থেকে তিনগুণ বেশি দামে সিনেমার টিকিট কিনত। বছরের পর বছর বন্ধ থাকায় হলটি এখন ভুতুড়ে ভবনে পরিণত হয়েছে। মানুষ এখন সিনেমা দেখতে মাল্টিপ্লেক্সে যান।'
পুরান ঢাকার কাছে বেড়ে ওঠা ও প্রায়ই মতিঝিলে যাতায়াত করা মোতাহের হোসেন মাসুম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদিও ব্যাংকগুলো চলে যাচ্ছে তবুও অনেক জনপ্রিয় খাবারের হোটেল এখানে এখনো থেকে গেছে। অনেকে এখনো সেসব হোটেলে আসেন।'
১৯৫৮ সালে মতিঝিলে প্রতিষ্ঠিত দেশবন্ধু হোটেল অনেকের কাছে স্মৃতিজাগানিয়া হয়ে আছে।
এই এলাকার অন্যান্য জনপ্রিয় হোটেলের মধ্যে ঘরোয়া ও হিরাঝিলে প্রতিদিন অনেকে খেতে আসেন।
মোতাহের হোসেন মাসুম আরও বলেন, 'আশির দশকে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ভবন তৈরির সময় এর ক্যাফেটেরিয়ায় অন্যান্য অফিসের বড় কর্মকর্তারা খেতে আসতেন।'
পূর্বাণী হোটেল থেকে এখনো শীর্ষ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা খাবার নিয়ে যান বলে জানান তিনি।
রাতে মতিঝিল নেয় এক বিস্ময়কর রূপ।
কাজ শেষে সবাই বাড়ি ফেরেন যখন তখন পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ও সরকারি ছুটির দিনগুলোয় এর সুপ্রশস্ত রাস্তাগুলো হয়ে উঠে শিশুদের খেলার মাঠ!
Comments