আমানতের সুদহার বাড়লেও ব্যাংকগুলোর টাকার অভাব কাটছে না

ব্যাংকের টাকার অভাব
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

আমানতের সুদহার বাড়ানোসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলোর টাকার অভাব কাটছে না। ফলে, কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক সংকট আরও বেড়েছে।

সংকটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণ, আমানত প্রবৃদ্ধি ও ঋণ পুনরুদ্ধারে ধীরগতি এবং বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকিং খাতে সাধারণ মানুষের আস্থার অভাব।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংকট কাটানোর উদ্যোগ নিলেও ব্যাংকগুলো টাকার অভাব কাটাতে পারেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর বলেছিলেন, ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে নতুন করে টাকা ছাপানো হবে না। এর পরিবর্তে তাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকগুলো প্রতিদিনের পরিচালন চাহিদা মেটাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ঋণ নিতে হিমশিম খাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

গত ২৩ নভেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৯০ দিনের মেয়াদি ঋণের সুদের হার সর্বকালের সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়।

একইভাবে নভেম্বরে তলবি মুদ্রাবাজারে (কল মানি) এক দিনের (ওভারনাইট) সুদের গড় হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। গত বছরের একই মাসে তা ছিল আট দশমিক ১৯ শতাংশ।

ব্যাংক কর্মকর্তা আনিস এ খান মনে করেন, সম্পদ ও দায়বদ্ধতার মধ্যে অসামঞ্জস্যতা থেকেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষ করে ইসলামি ব্যাংকগুলোয় সম্পদ বাড়লেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশে আছে মন্দ ঋণ। এটি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কম।

তিনি বলেন, 'এসব খেলাপি ঋণের কারণে নতুন করে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকে টাকা না আসায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।'

উপরন্তু, পাচার হওয়া টাকা ও ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার সম্ভাবনা সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এ সব ঘটনা আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে বেশি সুদ নিতে বাধ্য হচ্ছে।

গত সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ।

মন্দ ঋণে টাকা আটকে থাকায় অনেক ব্যাংক, বিশেষ করে ইসলামি ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের চাহিদা মেটাতে বা নতুন ঋণ দিতে পারছে না।

এটি ব্যাংকগুলোর প্রতিদিনের কাজ পরিচালনা ও নতুন ঋণ দেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খেলাপি হওয়া টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে হারানো টাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো।'

উপরন্তু, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর্থিক অব্যবস্থাপনা সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। এটি প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধনের প্রায় ৯৫০ শতাংশ। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার মন্দ ঋণ যোগ হওয়ায় ব্যাংকটির মন্দ ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

এ দিকে, এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ছয় ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর ৭৯ শতাংশ টাকা ইসলামী ব্যাংক দিয়েছে।

এটি গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের মোট বকেয়া ঋণের পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশের সমান।

গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে এই শিল্প গোষ্ঠীর মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম কোথায় আছেন তা অস্পষ্ট থাকায় এই ঋণ উদ্ধার ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই কারণগুলো ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর জনসাধারণের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে আমানত কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার চাহিদা বেড়েছে।

আমানত বাড়াতে কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের সুদের হার ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

সামগ্রিক ব্যাংকিং পরিবেশ ভালো না হলে মানুষ আবারও তাদের টাকা ব্যাংকের বাইরে রাখার পথ বেছে নিতে পারে। এটি তারল্য সংকট আরও বাড়িয়ে দেবে।

তারল্য সংকটের আরেক কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতি।

গত অক্টোবরের শেষের দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর টাকার চাহিদা নিয়ন্ত্রণে সুদের হার ১০ শতাংশে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ২০২২ সালের মে মাসের পর থেকে ১১তম বৃদ্ধি।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উচ্চহারের ঋণ ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমিয়ে দিয়েছে। এটি ব্যাংকগুলোকে আমানত ও ঋণের ওপর সুদহার বাড়িয়ে দিতে বাধ্য করেছে।

সুদের এই উচ্চ হার ঋণের চাহিদা কমিয়ে দেওয়ায় তা তারল্য প্রবাহকে আরও সীমিত করেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তা আনিস এ খান জানান যে আমানত মূলত সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি থেকে প্রভাবিত হয়। দেশে মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালের মার্চ থেকে নয় শতাংশের বেশি।

তিনি বলেন, 'মানুষের হাতে টাকা না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই আমানত কমবে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ নেওয়ার নিয়ম কঠোর করায় টাকার সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সপ্তাহে একবারই ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেয়। আগে সপ্তাহে দুইবার ঋণ নেওয়া যেত।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা তাদের টাকা ব্যাংকে রাখছেন না।

গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের নজরদারিতে যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আছে, তাদের ব্যাংক হিসাব তদন্ত করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।

তাছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খারাপ পরিণতির ভয়ে যারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তারা তাদের সম্পদ তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করে অবৈধ উপায়ে টাকা বিদেশে পাচার করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত করা, কর আদায় ও কারখানার উৎপাদন বাড়ানো এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমেই এই সংকট দূর করা যাবে।

তাদের ভাষ্য, এ ধরনের সংস্কার ছাড়া বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ কমতেই থাকবে। তারল্য সংকট অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর চলতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা ডেইলি স্টারকে জানান, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ঋণ দেওয়া ছাড়া সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর তারল্য সহায়তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি সংকটে পড়া ছয় ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছে। সংকট কাটাতে বেশি পরিমাণ টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর নিয়োগের পর এ পর্যন্ত সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো ভালো ব্যাংকগুলো থেকে ছয় হাজার ৮৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা পেয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina regime silenced media

Chief Adviser's Press Secretary Shafiqul Alam yesterday said steps must be taken to ensure that no one can directly interfere with the media in the future like it was done during the ousted Sheikh Hasina government.

4h ago