বাকি বিশ্বের উপর যেভাবে ছড়ি ঘোরাবেন ট্রাম্প
আগামী জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবার শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তথা পৃথিবীর ইতিহাসে রচিত হতে যাচ্ছে নতুন এক অধ্যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো রাখেন, তাহলে সামনের বছরগুলোতে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
আগের মেয়াদে ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রনীতির নাম দিয়েছিলেন 'আমেরিকা আগে' নীতি। সুরক্ষাবাদী বাণিজ্য নীতি, ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার হুমকি, মুসলিম দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা, ইরান চুক্তি বাতিল করা, আবার তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করা—সব মিলিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আগের মেয়াদের চার বছর বেশ ব্যস্ত ও ঘটনাবহুল ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ দফায় ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতিতে আরও কট্টর মনোভাব দেখাতে পারেন। নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনের দুর্বলতার জন্যই এখন সারা বিশ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি।
ট্রাম্প ও রিপাবলিকান শিবির 'শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে শান্তি' নীতিতেও বিশ্বাসী। এই নীতির মূল লক্ষ্য একটিই, যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো মূল্যে বিশ্বে শান্তি বজায় রাখবে, বা নিজের স্বার্থ রক্ষা করবে। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও।
একাধিক পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিশ্লেষকদের লেখায় দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের সম্ভাব্য দেশ শাসন কৌশলের কিছু বিশেষ দিকের কথা বলা হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান
নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতির একটি ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থামিয়ে দেবেন এই যুদ্ধ। ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন।
তৃতীয় বছরে পা দেওয়া এই যুদ্ধে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। ট্রাম্প প্রশাসন চাপ দিলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির আলোচনার টেবিলে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না। সেক্ষেত্রে রাশিয়া ইউক্রেনের যতটুকু ভূখণ্ড দখল করেছে, কিয়েভ তার দাবি ছেড়ে দিলে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে এগুতে পারে ইউরোপের এই দুই প্রতিবেশী দেশ। গত ফেব্রুয়ারিতে এমনই একটি প্রস্তাব দিয়েছিল ক্রেমলিন। তবে সেই প্রস্তাব রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন জেলেনস্কি ও তার পশ্চিমা মিত্ররা।
সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ট্রাম্প শিবির থেকে ইউক্রেনকে জানানো হয়েছে, ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে এই সংকট মোকাবেলায় ইউক্রেনকে সাহায্য করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। যার মানে, এই সংকটে রাশিয়ার পক্ষেই অবস্থান নিতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাগ্রহণ দূরে থাকলেও ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তৎপরতা শুরু করেছেন ট্রাম্প। ফোন করেছেন পুতিন ও জেলেন্সকিকে।
আরও শক্তিশালী হবে ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব
জো বাইডেন ইসরায়েলের সঙ্গে 'ইস্পাত কঠিন' বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে এই দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
নির্বাচনী প্রচারণায় বিদায়ী প্রশাসনের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেছেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বাইডেন, যেটা ঠিক না। অক্টোবরে এক সমাবেশে তিনি বলেন, 'দারুণ কাজ করছে তারা (ইসরায়েল)। যদি নেতানিয়াহু বাইডেনের কথা শুনত, তাহলে এমন অবস্থানে থাকত না তারা।'
কট্টর ইসরায়েলপন্থী ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরিত করেন। এই মেয়াদেও ইসরায়েলকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ট্রাম্পের জামাতা ও সাবেক উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার গত মে মাসে গাজার ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে সরিয়ে সেখানে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা দেন। ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর তাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের কূটনীতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে 'আব্রাহাম অ্যাকর্ডস' নামে একটি চুক্তি সাক্ষরে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে ট্রাম্প প্রশাসন। এবার সৌদি আরবের সঙ্গেও একইরকম চুক্তি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন কাজ শুরু করলেও গাজার যুদ্ধের কারণে এই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অবস্থান যেমন আরও সুসংহত হবে, তেমনি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নও একরকম বিলীন হয়ে যাবে।
মার্কিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে
ট্রাম্পের 'আমেরিকা আগে' নীতি অনুযায়ী মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেবে নতুন প্রশাসন।
আগের মেয়াদে ন্যাটো থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারও তার সুর একইরকম। সেপ্টেম্বরে এক নির্বাচনী সমাবেশে তিনি বলেন, 'এতদিন আমাদের সঙ্গে শত্রুদের চেয়েও বেশি খারাপ আচরণ করেছে মিত্ররা। সামরিক সহায়তা দিয়ে আমরা তাদের রক্ষা করছি, আর অপরদিকে বাণিজ্য খাতে তারা আমাদের ধসিয়ে দিচ্ছে। এটা আর হতে দেব না।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। কিন্তু বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। যেমন সেপ্টেম্বরে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বলেছেন, 'ট্রাম্প সমর্থক ইলন মাস্কের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (এক্স) ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইন প্রয়োগ করার চেষ্টা করলে ন্যাটো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।'
শুধু মাস্ক না, ক্ষমতায় আসলে বহির্বিশ্বে সকল মার্কিন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর কর, শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণের মাত্রা পছন্দ না হলে কড়া অবস্থানে যেতে পারে তার প্রশাসন।
মার্কিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করতে ইউরোপের সঙ্গে একটি 'পারস্পরিক বাণিজ্য আইন' করার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। যার মাধ্যমে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে মার্কিন ব্যবসার উপস্থিতি বাড়বে।
নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে এক সমাবেশে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, 'তারা (ইউরোপ) আমাদের দেশে লাখো গাড়ি বিক্রি করবে, কিন্তু আমাদের গাড়ি কিনবে না, আমাদের কৃষিপণ্য নেবে না। এসব চলবে না। (আমি নির্বাচিত হলে) ইউরোপকে বড় মূল্য দিতে হবে'।
চীন ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ
দেশীয় ব্যবসাকে সাহায্য করতে শুধু ইউরোপ না, বিশ্বের সকল দেশের ওপরই শুল্ক বাড়াবে ট্রাম্প প্রশাসন। নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা সকল পণ্যের ওপর অন্তত ১০ শতাংশ শুল্ক ধরা হবে। কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই শুল্কের পরিমাণ ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে প্রথম মেয়াদেই বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছিলেন ট্রাম্প। এবার সেই যুদ্ধকে নতুন মাত্রায় নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী সংকটের জের ধরে মেক্সিকান পণ্যের ওপরও ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করার হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এখানে উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে মেক্সিকো থেকেই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তার এই শুল্কযুদ্ধের কারণে মার্কিন নাগরিকদেরই আগের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হবে। তবে এর সুবিধা নেবে বড় মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
বৈশ্বিক কূটনীতি: বিচ্ছিন্ন থাকার কৌশল
বৈশ্বিক কূটনীতিতেও 'আমেরিকা আগে', অর্থাৎ নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ীই অবস্থান নেবে ট্রাম্প প্রশাসন। নিজেদের স্বার্থে যায় না, এমন সব চুক্তি ও কার্যক্রম থেকে ওয়াশিংটনকে বিচ্ছিন্ন রাখবেন ট্রাম্প, এমনটাই প্রত্যাশিত। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রকে সারা বিশ্বের 'মোড়লের' ভূমিকা থেকে সরিয়ে আনবেন তিনি, যা সাম্প্রতিক সময়ের সব ডেমোক্র্যাটিক মার্কিন সরকারের মৌলিক পরিচয় ছিল।
প্রথম মেয়াদে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিল তার প্রশাসন। বাইডেন প্রশাসন আবার সেই চুক্তি গ্রহণ করে। ধারণা করা হচ্ছে, এই মেয়াদে আবার প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনবেন ট্রাম্প।
প্রথম মেয়াদে শুধু এই চুক্তি না; ইরানের সঙ্গে পারমানবিক চুক্তি, রাশিয়ার সঙ্গে পারমানবিক চুক্তি (আইএনএফ), মুক্ত আকাশ চুক্তি এবং দুটি অভিবাসন চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনেন তিনি। এবারও আন্তর্জাতিক পরিসরে একই পথে হাঁটতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।
সূত্র: রয়টার্স, সিএনএন, ভক্স
Comments