সেলিম কাবাব ঘর: মন জয় করে নেওয়া এক স্বাদের জাদু

সেলিম কাবাব ঘর
ছবি: ইনতিসাব শাহরিয়ার

কত ধরনের অনুভূতির কথাই তো আমরা বলি। আজ বলব ভিন্ন এক অনুভূতির কথা। দেখুন তো, এর সঙ্গে আপনি পরিচিত কি না।

ধরুন, আপনি কোনো একটা খাবারের এক কামড় মুখে নিলেন, এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝতে পারলেন যে আপনার মস্তিষ্ক কেবল ওই খাবারের স্বাদ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না!

অবশ্য আজকাল সব ফুড ব্লগার আর সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা শহরের সব নতুন রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার মুখে নিয়ে এই কথাটিই বলে। আমি তাদের কথা বলছি না। আমি বলছি আপনার কথা। আপনার মতো আরও অনেকের কথা, যারা রোজ জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত থাকেন, তারপর কোনো কোনোদিন বিশেষ কোনো খাবার মুখে দিয়ে ঠিক এই অনুভূতির দেখা পান।

এখন বুঝতে পারছেন? এখন নিশ্চয়ই বলবেন কোথাকার কোন খাবারটি আমার আসলেই চেখে দেখা উচিত!

একজন খাদ্য সমালোচক হিসেবে কাজের খাতিরেই বহু খাবারের স্বাদ নিতে হয়েছে আমাকে। এমন অনেক রেস্তোরাঁ আছে যেগুলো জনপ্রিয় হওয়ার আগেই সেখানকার খাবার চেখে দেখেছি আমি।

আপনি হয়ত ভাবছেন, কী দারুণ জীবন আমি যাপন করি! হয়ত কিছুটা ঈর্ষাও হচ্ছে। তবে কী জানেন? উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় গরম গরম কেচাপ মিশ্রিত কমলা রঙের স্যুপ খাওয়ার পর নিজের ভাগ্য নিয়ে বরং পরিহাসই করি আমি। মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব খাবার খেয়ে আমার জীবনটাই বুঝি ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরপরেও ভালো খাবারের প্রতি আমার প্রত্যাশা কমেনি।

মোহাম্মদপুর
ছবি: ইনতিসাব শাহরিয়ার

সম্প্রতি আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেলিম কাবাব ঘরের খাবার রিভিউ করার। এক্ষেত্রে শুরুতেই স্বীকারোক্তি দিয়ে নিই যে, আমি একজন কাবাব ভক্ত। এতটাই যে, অনেকে মনে করেন আমার ডাকনামের সঙ্গে কাবাবের মিল আছে বলেই আমি খাবারটি এত পছন্দ করি!

আসলে কাবাবের প্রতি আমার ভালোবাসা অনেকটা ঐশ্বরিক পর্যায়ের। তাই আমার এখনও সেলিমের কাবাব না খাওয়াটা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

প্রথমে পরিকল্পনা ছিল শুক্রবার দুপুরে যাব। কিন্তু ঢাকা শহরে পরিকল্পনা অনুযায়ী কী-ই বা করা যায়! পরের সোমবার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সেলিম কাবাব ঘরে যাবার সময় হলো, তাও রাত ৯টার পর। পৌঁছানোর পর মনে হলো, কিছু বোধহয় ভুল হচ্ছে।

আমি শুনেছিলাম দোকানটি দেখতে ততটা আহামরি নয়। কিন্তু পৌঁছে দেখি বেশ কেতাদুরস্ত একটি দোকান সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম, আমরা একই নামের কিন্তু ভুল দোকানে চলে এসেছি। হয়ত এটা আসল সেলিম কাবাবের নকল করে তৈরি। এরপর একটু ঘুরতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেলিম কাবাব ঘরে।

সেলিম কাবাব ঘর
ছবি: ইনতিসাব শাহরিয়ার

প্রথমে ভেবেছিলাম মোহাম্মদপুরের স্থানীয় বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে নেব যে, সেলিম কাবাবে গেলে কোন কোন খাবারের স্বাদ নেওয়া উচিত। কিন্তু এই ভাবনাটা এসেছিল অনেক দেরিতে, ফলে কোনো পরামর্শ ছাড়াই আমরা বসে যাই এবং বিফ রোল দিয়ে অর্ডার শুরু করি। ভেবেছিলাম, এটা খেতে খেতে বাকি খাবারগুলো এসে যাবে।

আমি বেশ পেশাদারত্বের সঙ্গেই খাবার খেতে শুরু করি। যে ছবিগুলো দেখছেন সেগুলোও আমি স্মার্টফোন দিয়ে তুলেছি। তবে এসবই হঠাৎ করেই থেমে গেল, যখন আমি বিফ রোলটিতে কামড় দিলাম। হঠাৎ করেই মনে হলো ব্যস্ত সড়কের কোলাহল যেন থেমে গেল। আমার দৃষ্টিতে তখন কেবল ছিল ওই রোল, বাকি দুনিয়া যেন হুট করেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম তখন দেখলাম তৈলাক্ত হাত দিয়ে আমার ফোনটি ধরে আছি। রোলের ছবি তোলার কথা তো মনেই নেই।

এরপর আমরা একে একে অর্ডার করি গরু আর মুরগির মাংসের শিক কাবাব, চাপ এবং রোল। এর মধ্যে গরুর মাংসের শিক কাবাবটি আমার মনে থাকা শিক কাবাবের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। কাঠকয়লার আগুনে যথাযথভাবে রান্না করা, যার মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের মশলার সঠিক মিশ্রণ। আর মশলার রহস্য একমাত্র দোকানের মালিকই জানেন।

এইসব খাবার সামনে থাকলে আপনি সত্যিই ভুলে যাবেন যে মানুষের পেটে খাবারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে। আর সেই অনুযায়ী আপনাকে খেতে হবে!

চাপগুলোর স্বাদও ছিল দারুণ। তবে সেটাকে আমি রোল বা শিক কাবাবের মতো নম্বর দেবো না। যদিও, এটাও চমৎকার সব মশলার সমন্বয়ে তৈরি এবং মাংস ছিল দারুণ রসালো।

যখন আমি এসব খাবারের মধ্যে ডুবে ছিলাম তখন আমার বন্ধু বলল, এখানে মগজ ভাজার স্বাদও নাকি দারুণ। সেলিম কাবাব ঘরের মগজ ভাজায় বাড়তি কোনো মশলা বা গন্ধ কিছুই ছিল না। তবু এটি অন্য সব জায়গার চেয়ে অনন্য।

খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দোকানির সঙ্গে কথা বলব। গত ৪৬ বছর ধরে তিনি এখানে দোকানটি চালাচ্ছেন।

তাকে আমি বললাম যে আমরা ভুল করে একই রকম আরেকটি দোকানে চলে গিয়েছিলাম, হয়ত ওটা সেলিম কাবাব ঘরের নকল শাখা। কিন্তু তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন। জানালেন, ওটাও তাদেরই শাখা। যেখানে আজ আমরা বসে খেয়েছি সেটায় কাঠকয়লায় রান্না হয়। আর নতুন দোকানে তেলে ভাজা খাবারগুলো তৈরি হয়। আমরা আজ যে চাপগুলো খেয়েছি, সেগুলো ওই দোকানেই তৈরি।

তখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। ক্রেতার ভিড় কমতে শুরু করেছে। জানতে চাই, কয়টা পর্যন্ত সেলিম কাবার ঘর খোলা থাকে?

তিনি হেসে বললেন, নতুন ভিড় যেকোনো সময় শুরু হয়ে যেতে পারে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকগুলো মোটরসাইকলে এসে থামল। অন্তত ৪০ জন নতুন ক্রেতা খাবারের অর্ডার দিলেন।

তাদের দেখে আমার আবারও লোভ জেগে উঠল। আমি আবারও তিনটি গরুর মাংসের শিক এবং তিনটি মুরগির চাপ অর্ডার করলাম বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অবশ্য বাড়ির লোকেরা ভাগে পাবে কি না, সেটা নিশ্চিত ছিলাম না!

আপনারা যারা এই লেখাটা পড়ছেন, তারা নিশ্চয়ই সেলিম কাবাবের সঙ্গে পরিচিত। আর ভাবছেন আমি কেন এটা নিয়ে এত মাতামাতি করছি। এটা ঠিক যে, এতদিন আমি এর খোঁজ পাইনি। কিন্তু আমার মনে হয় ভালোই হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ মানুষ যারা বছরের পর বছর ধরে সেলিম কাবাবে খাচ্ছেন, তাদের কাছে তো এটা একঘেয়ে আর পুরোনো হয়ে গেছে। তারা নিশ্চয়ই এখন নতুন কিছুর সন্ধান করছেন।

কিন্তু আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, অন্য কোথাও কাবাব খেয়ে তাদের আর ভালো লাগবে না। কারণ সেলিম কাবাবের স্বাদ এক কথায় অসাধারণ। যদিও একেকজনের মুখের স্বাদ একেক রকম, তবে সেলিম কাবাব আসলেই অনন্য।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago