ট্রাম্প আসলে কে—প্রেসিডেন্ট, টিভি তারকা, আসামি, নাকি ব্যবসায়ী?   

নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ফাইল ছবি: রয়টার্স
নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ফাইল ছবি: রয়টার্স

'ক্ষ্যাপাটে' মানুষটির অনেক পরিচয়। সেই মানুষটিই হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়ার চার বছর পর বিপুল বিতর্ক সঙ্গে নিয়েও অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে ফের 'বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর' দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।

মঙ্গলবার কোটি কোটি আমেরিকানের ভোটে দেশটির ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড  ট্রাম্প।

প্রথম নির্বাচনে জয়, পরেরবার হার, এরপর তৃতীয় নির্বাচনে আবার জয়; মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বশেষ এমন 'কামব্যাক' সম্পন্ন করেছিলেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড, ১৩২ বছর আগে। ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৯ এবং ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট, ডানপন্থী আন্দোলনের নেতা, ফৌজদারি মামলার আসামি, আবাসন ব্যবসায়ী, টিভি তারকা; ৭৮ বছরের দীর্ঘ জীবনে অনেকভাবেই পরিচিত হয়েছেন ট্রাম্প।

চলুন জেনে নেই আগামী জানুয়ারিতে 'মুক্ত বিশ্বের নেতা' হিসেবে আবার শপথ গ্রহণ করতে যাওয়া ট্রাম্প তার ৭৮ বছরের জীবদ্দশায় কোন কোন কারণে পরিচিতি পেয়েছেন। 

আবাসন সম্রাটের সন্তান

ট্রাম্পের জন্ম ১৯৪৬ সালে, নিউইয়র্কের কুইন্সে। তার বাবা ফ্রেড ট্রাম্প ছিলেন একজন শীর্ষ আবাসন ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিউইয়র্কে নতুন আবাসন প্রকল্পের হিড়িক পড়লে এর সুবিধা নিতে শুরু করে তার 'ট্রাম্প অর্গানাইজেশন'। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, ফ্রেড তার জীবদ্দশায় ২৭ হাজারেরও বেশি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করেছেন।

ডোনাল্ড তার বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। ছেলেকে শৃঙ্খলার মাঝে গড়ে তুলতে ১৩ বছর বয়সেই তাকে একটি সামরিক স্কুলে ভর্তি করেন ফ্রেড। নিউইয়র্ক মিলিটারি একাডেমিতে গিয়ে পড়াশোনা, খেলাধুলা সব খাতেই বেশ ভালো করতে শুরু করেন ট্রাম্প। বেসবলে তারকা খেলোয়াড় ছিলেন, একাডেমিতে সিনিয়র ক্লাসে পেয়েছিলেন 'ক্যাপ্টেন' পদমর্যাদাও।

১৮ বছর বয়সে নিউইয়র্কের ফোর্ডহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। দুবছর পর তাকে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি করা হয়, যেখান থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়ে বের হন।

বাবার ব্যবসায় 

বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বাবার দেখানো পথে আবাসন ব্যবসায় যোগ দেন ট্রাম্প। ঠিক তখনই এক আইনি জটিলতায় পড়ে তাদের ব্যবসা। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন পাস হওয়ার পর বর্ণ বা জাতিগত বৈষম্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ফ্রেড ট্রাম্পের আবাসন প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ অভিযোগ আনে, তারা কৃষ্ণাঙ্গদের ভাড়া দেন না।

এই অভিযোগের বিপরীতে ট্রাম্প উল্টো বিচার বিভাগের নামে মামলা ঠুকেন। এবং জয়ী হন।

ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্পের প্রথম বড় প্রকল্প হয় 'ট্রাম্প টাওয়ার'। ১৯৮৩ সালে নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে নির্মিত ৫৮ তলা এই বিল্ডিংকে এখনো 'আভিজাত্যের প্রতীক' হিসেবে দেখা হয়।

অন্যান্য ব্যবসা

আবাসন ব্যবসায় সুনাম কুড়ানোর পর অন্যান্য ব্যবসাতেও মনোযোগ দিতে শুরু করেন ট্রাম্প। 'ট্রাম্প শাটল' নামে একটি বিমান সংস্থা খুলেন, নিউ জার্সিতে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন, ফুটবল লিগে একটি ক্লাব কেনেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠান মিস ইউনিভার্স অর্গানাইজেশনকেও কিনে নেন। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরও অনেক ব্যবসা ও পণ্যে ট্রাম্প নিজের নাম যোগ করেন। ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়, মদ কোম্পানি ট্রাম্প ওয়াইন, পানির বোতল ট্রাম্প আইস, ট্রাম্প ফার্নিচার, ট্রাম্প টাই, ট্রাম্প ডিওডোরেন্ট, ট্রাম্প স্টেক, এমনকি ট্রাম্প আন্ডারওয়্যার নামেও পণ্য বাজারে আনেন তিনি।  

ট্রাম্পের ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করে। ট্রাম্পের বিমান সংস্থা তিন বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ বছর স্থায়ী হয়। তার অন্যান্য ব্যবসা বা পণ্যও ব্যবসাসফল হয়নি।

তবে এসব ব্যবসা এবং গণমাধ্যমে দেওয়া তথ্য ও সাক্ষাতকারের মাধ্যমে সবসময় আলোচনায় থাকার চেষ্টা করেন ট্রাম্প। ইকোনোমিক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ শতকের শেষ ১৫ বছরে নিউইয়র্কের ট্যাবলয়েডগুলোর প্রথম পাতায় মোট ৮৭বার জায়গা করে নিয়েছিলেন ট্রাম্প।

যত অভিযোগ

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এফবিআই ও নিউইয়র্কের বিচার বিভাগ বিগত ৫০ বছরে ট্রাম্পের অনেক অপরাধ ও অনিয়মের তদন্ত করে এবং অভিযোগ আনে। এর মধ্যে রয়েছে আবাসনে বর্ণবিদ্বেষ, মাফিয়ার সঙ্গে আঁতাত, ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্থ পাচার।

দ্য নিউ ইয়র্কারের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে ট্রাম্পের সঙ্গে বিচ্ছেদের সময় তার প্রথম স্ত্রী ইভানা ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। ১৯৯৭ সালে জিল হার্থ নামে আরেক নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক্সিওসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট ২৭ জন নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন।  

স্ত্রী-সন্তান

এখন পর্যন্ত মোট তিনবার বিয়ে করেছেন ট্রাম্প। প্রথম স্ত্রী ইভানা ট্রাম্পের সঙ্গে তার বিয়ে স্থায়ী হয় ১৫ বছর (১৯৭৭ থেকে ১৯৯২)। ইভানা পেশায় একজন মডেল ছিলেন। তাদের একসাথে তিনজন সন্তান আছে- ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, এরিক ও ইভাঙ্কা ট্রাম্প।

দ্বিতীয় স্ত্রী মারলা ম্যাপলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থায়ী হয় চার বছর (১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭)। মারলার গর্ভে ট্রাম্পের চতুর্থ সন্তান, টিফানি ট্রাম্পের জন্ম হয়।

ট্রাম্প তার তৃতীয় ও বর্তমান স্ত্রী মেলেনিয়াকে বিয়ে করেন ২০০৫ সালে। নিউইয়র্কে এই সাবেক স্লোভেনিয়ান মডেলের সঙ্গে ট্রাম্পের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তৎকালীন নিউইয়র্ক সিনেটর হিলারি ক্লিনটন। মেলেনিয়ার গর্ভে ট্রাম্পের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ব্যারন ট্রাম্পের জন্ম হয়।

প্রথম দফার প্রেসিডেন্সি

পূর্বে কোনো রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা না থাকলেও ২০১৫ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার জন্য আবেদন করেন ট্রাম্প। প্রার্থিতা জিতে ২০১৬ নির্বাচনে হিলারিকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছরে নানা বিতর্কে জড়ান ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্যের সাত দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচন জিততে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ, নব্য নাৎসিদের প্রশংসা করা, কোভিড মহামারী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, দুবার অভিশংসনের মুখে পড়া, ক্যাপিটল দাঙ্গায় মদদ দেওয়াসহ অসংখ্য বিতর্ক পিছু করে তার।

ফৌজদারি মামলা

ট্রাম্প একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন যার বিরুদ্ধে বেশকিছু ফৌজদারি মামলা আছে। ফেডারেল আদালতেও তার বিরুদ্ধে মামলা আছে।

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এই ঘুষের মামলায় ম্যানহাটনের আদালত ট্রাম্পকে ৩৪টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এছাড়া ২০১৬ নির্বাচনের ফলাফল বদলানোর চেষ্টা করায় জর্জিয়ার আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তিনি। এর বাইরে এবছর আরও দুটি মামলা মোকাবেলা করছিলেন ট্রাম্প।

তথ্যসূত্র: বায়োগ্রাফি ডট কম, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

4h ago