কর্ণফুলী টানেল: বাজে পরিকল্পনার সর্বোত্তম উদাহরণ
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বহুল আলোচিত টানেলটি এক বছর আগে চালু হয়েছে। এই টানেল দিয়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, বাস্তবে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ চলছে। ফলে, এই টানেল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে পরিমাণ টাকা দরকার তার চেয়েও কম হচ্ছে আয়।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
২০ অক্টোবর পর্যন্ত এই টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার ৯১০টি যানবাহন চলাচল করেছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, যান চলাচল থেকে টানেলের দৈনিক গড় আয় ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।
কিন্তু টানেলের দৈনিক পরিচালন ব্যয় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রকল্পের প্রাক্কলন প্রতিবেদন অনুসারে, এ বছর দৈনিক গড়ে ১৮ হাজার ৪৮৫টি যানবাহন এই টানেল ব্যবহার করবে।
৯৮৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে টানেলটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চায়না কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার।
এ ছাড়া, টানেলের জন্য চীন থেকে নেওয়া ৭০৫ মিলিয়ন ডলার ঋণের সুদও দিচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের মধ্যে মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে।
পর্যাপ্ত আয় না হওয়ায় এসব ব্যয় এখন করতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'বন্দর নগরী ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করতে এই একটি টানেল কতটা দরকার ছিল, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেনি।'
তার মতে, 'যেহেতু প্রকল্পের ব্যয় বেশি, তাই এখান থেকে কোনো দিন প্রত্যাশিত আয় হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।'
টানেলটি উদ্বোধনের পর থেকে ১৪ লাখ ১২ হাজার যানবাহন চলাচল থেকে ৩৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আয় হয়েছে। কিন্তু তথ্য অনুযায়ী, সরকার এটি পরিচালনার জন্য ১৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
এই টানেল ব্যবহার করা যানবাহনের মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশ হালকা যান এবং ১২ শতাংশ ট্রাক।
এটি চালুর পর থেকে ৩৫৯ দিনে মাত্র তিনবার দৈনিক যান চলাচলের পরিমাণ ১০ হাজার ছাড়িয়েছে।
প্রকল্পটির উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'টানেলের দুই পাশে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। চীনের সাংহাইয়ের মতো "ওয়ান সিটি, টু টাউন' দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'এটা তৈরি করা হয়েছে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাশে চট্টগ্রাম বন্দর জেটি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ছিল, আনোয়ারায় হাজার হাজার দেশি-বিদেশি শিল্প ইউনিট স্থাপনের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। এর ফলে শুরুতে প্রত্যাশিত গাড়ির সংখ্যা কম।'
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি আরও বলেন, 'আগামী বছরের শুরুতে ঋণ পরিশোধ শুরু হলে টানেলের ব্যয় আরও বাড়বে।'
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'টানেলের ওপর নির্ভরশীল শিল্প-কারখানা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। টানেল নির্মাণের আগে শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করা হয়নি।'
'গত কয়েক বছর ধরে অর্থনীতির অবস্থার কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতেও আগ্রহী ছিলেন না,' যোগ করেন তিনি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, '২৩০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের পর টানেল দিয়ে যান চলাচলের পরিমাণ আরও বাড়বে। আগামী কয়েক বছরে এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যাবে না। কাজেই এখান থেকে আয় করে সেই টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তবে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ও বে টার্মিনাল সম্পূর্ণরূপে চালু হলে হয়তো এই টানেলের সুফল পাবো।'
অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'টানেলটি বন্দর নগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। তবে চীনের অর্থায়নে আনোয়ারায় একটি টাউনশিপ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।'
২০১৫ সালের নভেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) আট হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেয়।
পরে সেটার খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৪২ লাখ টাকায়। তখন প্রাক্কলন করা হয়েছিল যে, ২০২৫ সালের মধ্যে টানেলের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি যানবাহন চলাচল করবে।
অর্থায়নের ক্ষেত্রে, চীনের এক্সিম ব্যাংক ৭০৫ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার বা পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা দুই শতাংশ সুদ ও শূন্য দশমিক দুই শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে দিয়েছে এবং বাকি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরের মধ্যে এই চীনা ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
Comments