নির্মম সত্যের নির্ভীক কথক হান কাং
ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পরপরই বিদ্বৎসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল 'দ্য ভেজেটারিয়ান'। নোবেল জয়ী হান কাংয়ের বইটি ডেবোরা স্মিথের অনুবাদ নিয়ে কিছু বিতর্ক হয়েছিল বটে, তাতে বইটির জনপ্রিয়তা কমেনি। ২০১৬ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার জিতে নেয় বইটি। আট বছর পর হান কাংয়ের সাহিত্যে নোবেল জেতার পেছনেও রয়েছে 'দ্য ভেজেটারিয়ানে'র বড় রকমের ভূমিকা।
কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গোয়াংজুতে ১৯৭০ সালে জন্ম নেন হান কাং। বাবা হান সুং-ওনও ছিলেন সাহিত্যিক। ফলে বেড়ে ওঠা সাহিত্যিক পরিবেশে। লেখক হিসেবে ততটা সফল ছিলেন না হান সুং-ওন। শৈশব থেকেই বাবাকে আর্থিকভাবে সংগ্রাম করতে দেখেছেন হান। তবে এ নিয়ে দুঃখ থাকলেও ঘরভর্তি বই সে দুঃখে অনেকটাই প্রলেপ দিয়েছিল। হানের বয়স যখন নয় বছর, গুয়াজু ছেড়ে সিউলে চলে আসে তাঁর পরিবার। এর কিছুদিন পর গুয়াংজুতে গণতন্ত্রপন্থী ছাত্রজনতার মিছিলে গুলি ছুঁড়ে সেনারা, মারা যান কয়েকশো মানুষ। ঘটনাটি হানের মনে গভীরভাবে ছাপ ফেলে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্টস' গুয়াংজু গণহত্যাকে উপজীব্য করেই রচিত।
ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন হান। সাহিত্যরচনায় হাতেখড়ি কবিতা দিয়ে হলেও অচিরেই লিখতে শুরু করেন গদ্য। প্রথম উপন্যাস ব্ল্যাক ডিয়ার প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে, হারিয়ে যাওয়া এক নারীকে নিয়ে। হান বলেছেন, ঐ সময় থেকেই একটা গল্পের খসড়া তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে, যার বিষয়বস্তু এক নারীর বৃক্ষে পরিণত হওয়া। এটিই শেষমেষ রূপ নেয় 'দ্য ভেজেটারিয়ান'-এ। এরপর আরও সাতটি উপন্যাস, কয়েকটি উপন্যাসিকা এবং প্রবন্ধ ও ছোটগল্পও লিখেছেন হান।
দ্য ভেজেটারিয়ানের মতো সাড়া জাগাতে পারেনি আর কোনোটি। ডেবোরা স্মিথের অনুবাদের প্রথম দশ পৃষ্ঠা পড়েই বৃটিশ প্রকাশক তড়িঘড়ি করে কিনে নেন প্রকাশের স্বত্ত্ব। বই বাছতে ভুল করেনি তারা। সমালোচক ও সাধারণ পাঠক উভয়েরই প্রশংসাধন্য হয়েছে বইটি। বইয়ের শুরুটা বেশ সাদামাটা। সাদাসিধে, আপাতদৃষ্টিতে বৈশিষ্ট্যহীন এক নারী ইয়ং-হাই। এক সকালে ফ্রিজ থেকে সব মাংস ফেলে দিতে শুরু করে সে। স্বামী চিয়ং-কে জানায়, রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে, এ কারণে কোনোদিন আর মাংস খাবে না। চিয়ং-এর কাছে এতোদিন ইয়ং-হাই ছিল অচেনা এক মানুষের মতো, যার নিজস্ব সত্তা বলতে কিছু ছিল না। স্ত্রীর এই হঠাৎ পরিবর্তনে বিব্রত আর রাগান্বিত বোধ করে সে। জোর খাটাতে শুরু করে ইয়ং-হাইয়ের ওপর। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ না করে নিষ্ক্রিয় অসহযোগিতার পথ বেছে নেয় ইয়ং-হাই।
কেবল চিয়ং নয়, গোটা পরিবারই তখন তার ওপর খড়গহস্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষেপে তার বাবা, ভিয়েতনাম যুদ্ধফেরত অবসরপ্রাপ্ত এক সৈনিক। একদিন খাবার সময় জোর করে মেয়েকে শুকরের মাংস খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে সে। সবার সামনে তখন ছুরি দিয়ে নিজের কব্জি কেটে ফেলে ইয়ং-হাই। তাকে ভর্তি করা হয় মানসিক চিকিৎসালয়ে। বইয়ের শেষ দিকে বড়বোন ইন-হাই দেখা করতে আসে তার সঙ্গে। এতোদিন বোনের কর্মকা-কে পাগলামো বলে মনে করলেও ইন-হাই বুঝতে পারে, এতোদিন বিচক্ষণতা নয়, বরং ভীরুতা আর মেরুদ-হীনতারই পরিচয় দিয়েছে সে। হাসপাতালে এই তিন বছরে ইয়ং-হাইয়ের ওজন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ছেষট্টি পাউন্ড। সে কল্পনা করে, বৃক্ষ হয়ে গেছে সে, প্রাণশক্তি আহরণ করছে সূর্য থেকে। 'দেখো, বোন,' ইন-হাইকে বলে সে, 'হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার শরীর থেকে পাতা জন্মাচ্ছে। হাত থেকে বেরিয়ে আসছে শেকড়, চলে যাচ্ছে মাটির গভীরে। যাচ্ছে, যাচ্ছে, অন্তহীন এ যাত্রা। হ্যাঁ, পা দুটো মেলে দিয়েছি, কারণ আমি চাই আমার ঊরুসন্ধি থেকে ফুটে উঠুক ফুল।'
হান কাংয়ের আরেক বিখ্যাত উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্টস' প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। ডং হো নামে পনের বছর বয়সী এক বালক এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। গোয়াংজু শহরে গণতন্ত্রকামী মানুষের ওপর সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চলছে, এর মধ্যেই এক বন্ধুকে খুঁজতে রাস্তায় নামে সে। ছাত্ররা তাকে দায়িত্ব দেয় এক সরকারি ভবনে স্তূপ হয়ে থাকা লাশ গোনার। মৃত্যুর ভয়াল রূপকে কাছে থেকে দেখে ডং হো। মাঝে মাঝেই বিক্ষোভরত জনতার মিছিল থেকে জাতীয় সঙ্গীত ভেসে আসে। বিস্মিত ডং হো জানতে চায় জনতা কেন জাতীয় সঙ্গীত গাইছে, যেখানে সৈন্যেরা এভাবে মানুষ মারছে? অন্যেরা জানায়, সৈনিকদের দোষ নেই, যত দোষ জোর করে ক্ষমতায় বসে থাকা জেনারেলদের। ডং হো বুঝতে পারে, যে প্রশ্নটি সে করতে চায় সেটি আরও গভীর এবং বিমূর্ত। সে আসলে জানতে চায়, সরকার যায় সরকার আসে, নির্মমতা কেন কমে না। সে জানতে চায়, স্বাধীনতা শব্দটির অর্থ আসলে কী। সেনারা গোয়াংজু পুনর্দখল করলে আত্মসমর্পণ করে ডং হো, কিন্তু গুলি করে মারা হয় তাকে।
প্রতিটি অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে একজন করে ব্যক্তির গল্প, ডং হোর অপমৃত্যু যাদের কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে। এদের মধ্যে আছে এক ছাত্র, বড় হয়ে যে পত্রিকার সম্পাদকের পেশা বেছে নেয় এবং যার কাজ হচ্ছে গণহত্যার তথ্যকে সেন্সর করা। আছে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়া এক রাজবন্দি, পরে যে আত্মহত্যা করে। আছে কারখানায় কাজ করা এক মেয়ে, যে পরবর্তীতে শ্রম অধিকার আন্দোলনের কর্মীতে পরিণত হয়। আর আছে ডং হোর মা, পুত্রের মৃত্যু যাকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ায়। বইতে 'তুমি' সর্বনামের ব্যাপক ব্যবহার করা হয়েছে, যেন মৃত্যু আর ধ্বংসের তা-বলীলা থেকে পাঠককে বিন্দুমাত্র রেয়াত দিতে চাইছেন না লেখক। বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় 'বালকের বন্ধু, ১৯৮০' শিরোনামের অধ্যায়টি। অধ্যায়টি ডং হোর বন্ধু জিয়ং দেকে নিয়ে। দুই বন্ধু রাস্তার হাল অবস্থা দেখতে গেলে পুলিশ গুলি করে মারে জিয়ং দেকে। এক ভবনের কোনায় গুটিশুটি মেরে মেরে বসে ডং হো দেখে মৃত্যুর আগে বন্ধুর পা দুটো কীভাবে কাঁপছে। জিয়ং দের গল্পের কথক হচ্ছে তার আত্মা।
লাশের স্তূপের মধ্যে পড়ে আছে জিয়ং দে, একটু একটু সব রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। আত্মা এখনও আটকে আছে শরীরের সঙ্গে, ঠিক যেভাবে গাছের ডালে আটকে থাকে বায়ুশূন্য নেতানো বেলুন। শরীর নামের আশ্রয়স্থলের মৃত্যু হয়েছে, এখানে আর থাকা যাবে না- জিয়ং দের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে এই মহাসত্য। মৃত মানুষের আত্মা, যারা একে অন্যকে স্পর্শ করে থাকে, অথচ পুরোপুরি যুক্ত হতে পারে না তাদেরকে বর্ণনা করা হয়েছে বিষন্ন অগ্নিশিখা হিসেবে যারা কাচের দেয়ালে মাথা কুটে মরে এবং শেষে নিঃশব্দে সরে যেতে বাধ্য হয়। 'হিউম্যান অ্যক্টস' থেকে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করা যায়: 'কাচ স্বচ্ছ, তাই না? এবং ভঙ্গুর। এটি হচ্ছে কাচের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
তিনি যখন গর্ভে, ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর মা। প্রচুর ওষুধ খেতে হতো তাকে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন, গর্ভপাত করবেন। তারপর একদিন টের পেলেন, পেটের মধ্যে নড়াচড়া করছেন হান। সিদ্ধান্ত বদলালেন মা। ঠিক করলেন, জন্ম দেবেন সন্তানকে। 'পৃথিবী খুবই অনিত্য,' এ প্রসঙ্গে বলেছেন হান। 'দুনিয়ায় আমি এসেছিই ভাগ্যক্রমে।' ভাগ্যিস এসেছিলেন
এ কারণেই কাচের তৈরি জিনিসপত্র সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয়। সেগুলো ভেঙে গেলে, ফেটে গেলে, বা চিড় ধরলে অকোজ হয়ে যায়। ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আগে আমাদের কাছে এমন এক ধরনের কাচ ছিল যা ভাঙে না। কঠিন আর স্বচ্ছ এক সত্য, যেন তা কাচের তৈরি। কাজেই এটি নিয়ে ভাবলে দেখবে, আমরা যখন ভেঙে যাই তখনই বুঝতে পারি, আমাদের আত্মা আছে। তার মানে আমরা আসলে কাচের তৈরি মানুষ।'
'দ্য হোয়াইট বুক' প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে এবং পরের বছরই ম্যান বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। হান কাংয়ের এক বোন জন্মের কিছুকাল পরই মারা গিয়েছিল। সেই বোনের মৃত্যুকে ঘিরে তাঁর মায়ের শোক এ বইয়ের বিষয়বস্তু। সাদা রং মৃত্যু, শোক, জন্ম এবং সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি বইতেও কয়েকটি পৃষ্ঠা সাদা রেখে দিয়েছেন হান। 'আমি চেয়েছি ক্ষতস্থানের ওপর দেওয়া পট্টি কিংবা শরীরের ফুলে ওঠা জায়গায় লাগানো সাদা মলমের মতো কিছু একটায় রূপ নিক আমার লেখা,' এ বইটি সম্বন্ধে বলেছেন তিনি।
হান-এর লেখাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে তার কাব্যিক ভঙ্গি এবং নিরীক্ষার প্রবণতা। হয়তো কবিতা দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু করার কারণেই এ কাব্যময়তা। তাঁর ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি, চিত্রকল্প সবই ছুরির মতো ধারালো। জঁরার ব্যবধান অনায়াসে ঘুচিয়ে দেন তিনি, ফলে জন্ম নেয় এমন সাহিত্যকর্ম যা অংশত উপন্যাস, অংশত কবিতা। রূপক ব্যবহারে দক্ষতার কারণে ভিন্ন এক স্বাদের সন্ধান দেয় তার লেখা। জীবনের নির্মম বাস্তবতার কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা করেন না কখনও, বরং একে ব্যবহার করেই মানব অস্তিত্বের নিগুঢ় সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
নিজের লেখালেখির প্রেরণা সম্বন্ধ হান কাং বলেছেন, মানুষের জীবনকে ঘিরে কিছু মৌলিক প্রশ্ন আছে, সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই লেখালেখি শুরু করেন তিনি। কাং-এর ভাষায়, 'উপন্যাস লেখার সময় বুঝতে পারি, উত্তর নয়, আমি আসলে প্রশ্নগুলোর শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে চাইছি। মানবজীবনের অর্থ কী? এ প্রশ্নটির মর্মে প্রবেশ করতে গিয়েই গভীর নানা দৃশ্য ও চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে হয়েছে আমাকে।' 'লেখালেখির সময় ইন্দ্রিয়ের ওপর যথেষ্ট জোর দিই আমি,' এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি। 'শোনা, দেখা, স্পর্শ করা- এসবের অনুভূতি পাঠকের মধ্যে সঞ্চার করতে চাই। এসব অনুভূতিকে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতোই শব্দ ও বাক্যের মধ্যে প্রবিষ্ট করি এবং অদ্ভুতভাবেই, পাঠকও টের পান সেই প্রবাহকে। পাঠকের সঙ্গে এই সংযুক্তির অভিজ্ঞতাটি আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
আরেক সাক্ষাৎকারে নিজের সম্বন্ধে চমকপ্রদ এক তথ্য দিয়েছিলেন হান। জানিয়েছিলেন, তিনি যখন গর্ভে, ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর মা। প্রচুর ওষুধ খেতে হতো তাকে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন, গর্ভপাত করবেন। তারপর একদিন টের পেলেন, পেটের মধ্যে নড়াচড়া করছেন। সিদ্ধান্ত বদলালেন মা। ঠিক করলেন, জন্ম দেবেন সন্তানকে। 'পৃথিবী খুবই অনিত্য,' এ প্রসঙ্গে বলেছেন হান। 'দুনিয়ায় আমি এসেছিই ভাগ্যক্রমে।' ভাগ্যিস এসেছিলেন। নইলে দুর্লভ প্রতিভার স্পর্শ থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম।
Comments