বাজছে বাদ্য, আসছেন দেবী 

পুরান ঢাকায় প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। প্রতি শরতে, সাধারণত আশ্বিন মাসে দেবী দুর্গার মহিষাসুর (অশুভ শক্তি) বধের বিজয় উদযাপন করেন তারা। 

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, অশুভ শক্তি মহিষাসুর দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ অধিকার করে। দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করেন। তিন প্রধান দেবতা একত্রিত হয়ে দেবী দুর্গার সৃষ্টি করেন। দুর্গা দশ হাতে দশটি শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন। এটিই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়। অন্যায়ের পরাজয়ের প্রতীক।

প্রতি বছর দেশের সব জায়গায়, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীসহ বড় শহরগুলোয় জাঁকজমকভাবে এবং গ্রামীণ জনপদে বিস্তৃত আকারে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়। প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি মণ্ডপ সজ্জা ও আরতির মধ্য দিয়ে এটি সামাজিক অনুষ্ঠানের রূপ নেয়।

তবে এ বছর দুর্গাপূজা এসেছে ভিন্নরূপে। এ বছরের দুর্গাপূজা এক অনন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যদিও উৎসবের মণ্ডপগুলোয় অনুভূত হচ্ছে শুদ্ধতার নতুন আভা। সংকটকে অতিক্রম করে ভেতরের শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার আশা সঞ্চারণ করছে।

দুর্গাপূজার সময়টায় পুরান ঢাকার অলিগলি সেজে উঠে নতুন সাজে। শাঁখারিবাজার ও তাঁতিবাজারের সরু রাস্তাগুলো উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কোনো দিনপঞ্জির হিসাব না রেখেও যদি এসব গলি ঘুরে আসা যায়, মানুষের আমেজ ও কাজকর্ম দেখে হলফ করে বলে দেওয়া যায় সামনে কোনো না কোনো উৎসব আছে। 

ছবি: ব্রততী সাহা

ওই এলাকার সবাই জানেন পূজার সময়সূচি। তখন এসব গলির প্রায় পুরোটাই কিছু সময়ের জন্য হয়ে ওঠে পূজা মণ্ডপ। তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। গলিতে নেই আগের মতো আড়ম্বর, মণ্ডপের কাজও চলছে ধীরগতিতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার মন্দিরের এক পুরোহিত বলেন, 'নিয়মনীতি ঠিক রেখে পূজায় যা যা প্রয়োজন সবই করা হচ্ছে। দেবীর পূজায় কোনো কমতি রাখা হবে না। উৎসবের মূল চেতনা তো আমাদের ভেতর থেকেই আসে। যত প্রতিকূলতাই আসুক, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐক্য আমাদের শক্তি।'

তিনি আরও বলেন, 'দেবী এবার ধরণীতে আসছেন দোলায় চড়ে। ফিরবেন হাতির পিঠে। অর্থাৎ মড়কের আশঙ্কা নিয়ে এলেও যাওয়ার সময় তিনি শস্যপূর্ণ ধরণী দিয়ে যাবেন আমাদের। সবাই মিলে প্রার্থনা করছি যেন মা দুর্গা আমাদের সব অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করেন।'

ঢাকার বেশ কয়েকটি মন্দির ঘুরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি নজরে এসেছে তা হলো— নিরাপত্তা শঙ্কা। পূজা উৎযাপন কমিটির একজনের সঙ্গে কথা বলেও বিষয়টির আঁচ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মণ্ডপগুলোয় বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হচ্ছে। উৎসবের উদ্যোক্তারা চেষ্টা করছেন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপন নিশ্চিত করা যায়।

এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও দুর্গাপূজা সামাজিক ঐক্য, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আশার প্রতীক হিসেবে মানুষকে একত্রিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন তিনি।

রামকৃষ্ণ মিশন ঘুরে জানা যায়, এ বছর দুর্গাপূজায় হচ্ছে না কুমারী পূজা। এর আগেও করোনা মহামারির সময় সেখানে কুমারী পূজা হয়নি। মন্দিরের সামনের মাঠে প্রতিবার পূজার আয়োজন করা হলেও এবার হচ্ছে মন্দিরের ভেতরে।

ছবি: ব্রততী সাহা

শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পীরা। মূর্তিতে এখন লাগছে রঙের ছোঁয়া। তুলির আঁচড়ে সুনিপুণ হাতে ফুটে উঠছে মায়ের মুখচ্ছবি। তবে প্রতিমা শিল্পীরা জানান, এ বছর কমেছে প্রতিমা ও মণ্ডপ তৈরির খরচ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিমার কাজ চলছে মন্দিরের ভেতরে। প্রতিমা শিল্পীরা জানান, প্রতিবার মন্দিরের বাইরে খোলা জায়গায় প্রতিমা তৈরির কাজ করলেও এবার মন্দিরের ভেতরে কাজ করছেন। যখন কাজ বন্ধ থাকছে, তখন মন্দিরের দরজাও বন্ধ রাখা হচ্ছে।

এবারের দুর্গাপূজা দেশের জন্য এক নতুন বাস্তবতা সামনে এনেছে। উৎসবের আনন্দ ও চেতনার সঙ্গে মিশেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার আতঙ্ক। তবে দেবী দুর্গার প্রতীকী শক্তি ভক্তদের মনোবল অটুট রেখেছে। পূজার মাধ্যমে আশার আলোকবিন্দু খুঁজে নেবেন তারা।

দেবীর দশ হাতে যেমন অশুভ শক্তিকে বধের অস্ত্র, তেমনই ভক্তদের হৃদয়ে সাহসের আলো জ্বলে উঠছে। তাদের প্রার্থনা যেন সমাজের বিভাজনকে মুছে ফেলে ঐক্যের সেতু নির্মাণ করছে। মণ্ডপগুলোয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রার্থনা নতুন উদ্দীপনা তৈরি করছে।

এই উৎসব মানসিক পুনর্জাগরণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভক্তদের মনে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাহস, বিশ্বাস ও শান্তির বার্তা।

Comments

The Daily Star  | English
government reduces heart stent prices in Bangladesh

Govt slashes heart stent prices by up to Tk 88,000

Health ministry revises rates for US-made coronary stents to ease patient costs

1h ago