গাজী টায়ারের আগুনে পুড়েছে শ্রমিকদের কপাল

পুড়ে যাওয়া গাজী টায়ার্স কারখানা। ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসীতে যখন দুর্বৃত্তদের আগুনে গাজী টায়ার্সের কারখানা পুড়ছিল, তখন কারখানা থেকে একটু দূরে ছিলেন বিল্লাল হোসেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর তিনি সেই আগুনের লেলিহান শিখায় নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখতে পান।

কুমিল্লার বিল্লাল গত ১৭ বছর ধরে কারখানার প্রশাসন বিভাগে কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করতেন।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লাগাতার আগুন ও লুটপাটের কারণে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন শত শত শ্রমিকের মতো তিনিও চাকরি খুঁজছেন।

বিল্লাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২২ হাজার টাকা পেতাম। থাকতাম কারখানার কোয়ার্টারে। চাকরি হারানোর পর বাসা ভাড়া নিতে হয়েছে। চাকরির জন্য চার জায়গায় আবেদন করেছিলাম। কেউই ১০ হাজার টাকার বেশি দিতে চায়নি। এমন ব্যবহার করেছে যেন আমি নতুন।'

বিল্লালের মতো গাজী টায়ার্সের কমপক্ষে দুই হাজার কর্মীকে এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, যারা সেই আগুনের পর চাকরি হারিয়েছেন।

গত ৫ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে এক সময়ের সমৃদ্ধ কারখানাটিতে লুটপাট চালানোর পাশাপাশি আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনাকে স্থানীয়দের অনেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বছরের পর বছরের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে হতাশার বিস্ফোরণ বলে মনে করেন।

গাজীর বিরুদ্ধে বিতর্কিত জমিতে কারখানা করার অভিযোগসহ স্থানীয়দের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগও এই অশান্তিতে ইন্ধন জুগিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

গত ২৫ আগস্ট কারখানার মালিক ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিন আবার আগুনের ঘটনা ঘটে। আগুন ছয়তলা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।

আগুনের সময় ভবনটিতে স্থানীয়দের অনেকে আটকা পড়েন বলে দাবি তাদের স্বজনদের। এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাঁচ দিন পর আগুন নেভানো গেলেও ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে।'

আগুন ও লুটপাটের পর কারখানাটির দুই হাজারেরও বেশি কর্মী ও শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। যারা এখনো চাকরিতে বহাল আছেন, তারাও রয়েছেন অনিশ্চয়তায়৷

অনেক মেশিন, যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য উপকরণ চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ে।

যারা গাজী টায়ারের কারখানায় কাজ করতেন, এখন তারা অনেকটা নিরুপায়।

কারখানার টিউব সেকশনের শ্রমিক নার্গিস তার নিদারুণ কষ্টের কথা জানিয়ে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারখানা বন্ধ হওয়ার পর আমার ভাই কুমিল্লায় ফিরে গেলেও কারখানা খুলবে এই আশায় স্বামীর সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকছি। যদি তা না হয়, তাহলে আমাকে চাকরি খুঁজতে হবে।'

১৮ বছর বয়সী শমসের দুই বছর ধরে গাজী টায়ার্সে কাজ করেছিলেন। কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি হন্যে হয়ে নতুন চাকরি খুঁজছেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবা অসুস্থ। ওষুধের দাম অনেক বেশি। আমরা গরিব। অলস বসে থাকতে পারি না। এখন গার্মেন্টসে কাজ খুঁজতেছি।'

কারখানা বন্ধের এই ঘটনা স্থানীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। অনেক শ্রমিকের বাসস্থান খাদুন গ্রামটিকে এখন 'ভুতুড়ে গ্রাম' মনে হয়।

স্থানীয় এক চা-বিক্রেতা আক্ষেপ করে বললেন, 'বেচাকেনা নাই। মানুষ আসে না।'

স্থানীয় মুদি দোকানদার জাকির হোসেন প্রধান সেখানে সস্তায় জমি অধিগ্রহণের জন্য গাজী গ্রুপের ওপর গ্রামবাসীর ক্ষোভের কথা বললেও আগুন-লুটপাট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

তিনি বলেন, 'অনেক মানুষ এ কারখানায় কাজ করত৷ এত এত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা কারখানায় আগুন দেওয়া মেনে নেওয়া যায় না।'

গাজী টায়ার্সের নির্বাহী পরিচালক মো. কামরুজ্জামানও একই কথা বলেন।

গত ৯ সেপ্টেম্বর তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম দফায় লুটপাটের পর প্রাথমিকভাবে শ্রমিক ছাঁটায়ের কথা ভাবা হয়নি। উৎপাদন বন্ধ থাকলেও সবাইকে আগস্টের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে৷ পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এত লোকসানের পর শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবো কি না, তা অনিশ্চিত। তাই অনেককেই ছাঁটাই করা হয়েছে৷'

তিনি সরকারের প্রতি সহায়তার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে মালিকদের তুলনায় শ্রমিকদের ক্ষতি বেশি হয়। এ কারখানা জাতীয় সম্পদ। সরকারের উচিত এটা রক্ষা করা।'

প্রায় ৩৬ একর জমির ওপর কারখানাটির ক্ষয়ক্ষতির পুরোপুরি জানা যায়নি।

রূপগঞ্জ থানার পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার জন্য শিল্প পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। লুটপাটে জড়িত ১০ জনকে গ্রেপ্তার ও জরিমানা করা হয়েছে।

কারখানা কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক মামলা না করায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এখনো শুরু হয়নি।

সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ১৯৭৪ সালে গাজী গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। কারখানায় প্লাস্টিক ও রাবার পণ্য উৎপাদিত হতো। ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি টায়ার ব্যবসা শুরু করে। এখানে প্রথমদিকে রিকশার টিউব তৈরি হতো।

২০০২ সালে রূপগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত গাজী অটো টায়ার্স দেশে প্রথম টায়ার তৈরি শুরু করে।

বছরের পর বছর ধরে গাজী টায়ার্স জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি হয়ে উঠে। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মীর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার ৬০০ জন।

দেশে রিকশা, তিন চাকার অন্যান্য বাহন ও ছোট গাড়িতে ব্যবহৃত টায়ারের চাহিদার ৭০ শতাংশ এই কারখানা থেকে পূরণ করা হতো। বাস ও ট্রাকের টায়ারের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ও মিনিবাসের ৬৫ শতাংশ পূরণ করত এই প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটি ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ লাখ টায়ার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পরবর্তী লুটপাট প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টায়ার বাজারে কারখানাটির অবদান নেতৃত্বস্থানীয়। এটি ধ্বংস হয়ে গেলে টায়ার ব্যবহারকারী, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের বিশাল ক্ষতি।'

তার ভাষ্য, 'দেশে হাতেগোনা কয়েকটি টায়ার তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে। গাজীর টায়ারের যে বিপুল চাহিদা, তা অন্যরা পূরণ করতে পারবে না।'

গাজীর কারখানা ধ্বংসের ঘটনাকে 'দুর্ভাগ্যজনক' হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত ৯ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টার আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, 'আমাদের উচিত ছিল তাদের রক্ষা করা।'

হাজারো শ্রমিক ও স্থানীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে গাজী টায়ারের কার্যক্রম আবার শুরুর ওপর।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

5h ago