নোয়াখালীর বন্যা এত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণ কী

জেলার লাখ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী। ভয়াবহ এই বন্যায় নোয়াখালীতে এখন পর্যন্ত ছয় শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
হাতিয়া বাদে নোয়াখালীর বাকি আটটি উপজেলার সবগুলোতে বন্যার পানি ঢুকেছে। ছবি: অনিক শাহরিয়ার/স্টার

ভারতের উজান থেকে আসা পানি এবং দেশের অভ্যন্তরে অতিভারী বৃষ্টিতে গত মাসে ভয়াবহ এক বন্যার সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ।

এদিকে নোয়াখালীর বাসিন্দারা এখনো লড়ে যাচ্ছেন এ অঞ্চলের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার সঙ্গে। জেলার লাখ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী। ভয়াবহ এই বন্যায় ইতোমধ্যে নোয়াখালীতে এখন পর্যন্ত ছয় শিশুসহ মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা গেছে অনেক গৃহপালিত প্রাণী।

আবার অনেক এলাকায় বন্যার পানি বের হতে না পেরে সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতার। এতে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এই পানি নামতে ঠিক কতদিন লাগবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ায় অস্থির হয়ে উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নেওয়া অনেকে।

এমন স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দারা যে বিষয়টিকে সামনে এনেছেন সেটা হলো—নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার যে বড় খালগুলো দিয়ে বৃষ্টি অথবা বন্যার পানি মেঘনা নদীতে যায়, সেসব খালের বিভিন্ন জায়গা দখল হয়ে গিয়েছে। স্লুইসগেট ও রেগুলেটরসহ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খালের ওপর এবং এর দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা।

এবার কেবল হাতিয়া বাদে নোয়াখালীর বাকি আটটি উপজেলার সবগুলোতে বন্যার পানি ঢুকেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর ভেতর আছে বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, চাটখিল, সোনাইমুড়ি ও সদর উপজেলা। এই উপজেলাগুলোর প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ জায়গা এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে।

বন্যায় এসব উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ৬০-৭০ হাজার মানুষ এখনো বাড়িতে ফিরতে পারেননি। এ কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সব শিক্ষা কার্যক্রম এখন বন্ধ। তাই অনেক জায়গায় প্রতিষ্ঠান চালুর জন্য কর্তৃপক্ষ আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দাদের অন্য জায়গায় সরে যাওয়ার কথা বলছেন।

নোয়াখালীর লাখ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী। ছবি: অনিক শাহরিয়ার/স্টার

বেগমগঞ্জের ভবানী জীবনপুর গ্রামের কফিল উদ্দিন (৬০) বলেন, 'বন্যার পানি গত ১৮ আগস্ট ঘরবাড়িতে উঠেছে। নামার নাম নাই। ঘরে এখনো হাঁটুপানি।

ষাটোর্ধ্ব এই পর্যবেক্ষণ হলো, এই গ্রামের পাশে বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়কের সঙ্গে একটি খাল আছে। স্থানীভাবে এটি গাবুয়া খাল নামে পরিচিতি। খালটি বসিরহাট, ছয়ানী রাজগঞ্জ ও মাইজদি হয়ে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে পড়েছে। ১০ বছর আগে ভবানী জীবনপুর থেকে সামনের দিকে তিন কিলোমিটার দূরে একটা স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়েছে। স্লুইসগেটটি নির্মাণের শুরু থেকেই তা এ খাল দিয়ে পানি নিষ্কাসনের কাজটিকে কঠিন করে ফেলেছে। ফলে বন্যার পানি কমছে না।

সেনবাগ উপজেলার বড় সর্দারপাড়ার মো. সেলিম জানালেন, এক মাস ধরে তাদের গ্রামের সব রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে। এই এলাকার সবগুলো খালের প্রায় ভরাট অবস্থা। যে যেভাবে পারে খালগুলো দখল করে রেখেছে।

সরকারের কাছে সেলিমের আবেদন, তাদের অন্য কোনো সহযোগিতার দরকার নেই। কেবল খালগুলো যেন পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে। তার ভাষ্য, নোয়াখালীতে আগে বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য শত শত দীঘি খনন করা হয়েছিল। পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল। ছিল নোয়াখাল, বেগমগঞ্জের অবদা খাল, ভুলুয়া খালসহ ছোটবড় অসংখ্য খাল। এই খালগুলোর মধ্যে যে আন্তঃসংযোগ ছিল সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন জায়গায় দখল নিয়ে প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভাটির পানি খাল বেয়ে নেমে যাওয়ার আর পথ নেই।

আব্দুল আউয়াল আরও জানালেন, আজকের মাইজদী শহরও গড়ে উঠেছে খালের ওপর। ওই খালটির নাম ছিল ছাগলমারি খাল। এর পাশেই ছিল নোয়াখাল।

আউয়ালের অভিযোগ, বিভিন্ন সময় খাল খননের জন্য যে সরকারি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তার পুরোটা কখনো কাজে আসেনি। জনপ্রতিনিধিরা এর অর্ধেকটাই মেরে দিয়েছেন।

বিদ্যমান সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এখন থেকে আগামী এক মাস ধরে স্যাটেলাইট থেকে এই অঞ্চলের পানি নামার পথগুলোকে চিহ্নিত করার তাগিদ দেন আব্দুল আউয়াল। পরে সে অনুসারে প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণের ওপর জোর দেন তিনি।

বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণগুলো জানতে চাইলে আব্দুল আউয়ালের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল। তিনি জানান, গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলায় মাত্র দুই সেন্টিমিটার বন্যার পানি কমেছে।

আমির ফয়সাল বলেন, 'জেলার চাটখিল, সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ ও সদর উপজেলার পানি লক্ষ্মীপুর জেলার রহমতখালী খালের মাধ্যমে রহমতখালী রেগুলেটর হয়ে মেঘনা নদীতে পড়ে। কিন্তু রহমতখালী খালের লক্ষ্মীপুর অংশ দীর্ঘদিন ধরে খনন করা হয়নি। যে কারণে আবর্জনা জমে খালের নাব্যতা কমে গেছে। পানি নামছে ধীর গতিতে।'

এই প্রকৌশলীর কাছ থেকে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নোয়াখালী সদর, কবিরহাট ও বেগমগঞ্জ উপজেলায় ১৬১ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়। এছাড়া ১৯৬৪ সালে সদর উপজেলার মান্নাননগর থেকে আটকপালিয়া (হারিছ চৌধুরীর বাজার) পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এলাকায় ক্রস ড্যাম নির্মাণ করা হয়। এর ফলে সুবর্নচর উপজেলার ৭১ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পেলেও ক্রসড্যামের কারণে সুবর্নচর উপজেলা সদর উপজেলার চেয়ে উঁচু ভূমিতে পরিণত হয়। ফলে সদরের পানি বের হওয়ার পথ কঠিন হয়ে পড়ে।

Comments

The Daily Star  | English

Six state banks asked to cancel contractual appointments of MDs

The Financial Institutions Division (FID) of the finance ministry has recommended that the boards of directors of six state-run banks cancel the contractual appointment of their managing directors and CEOs..The six state-run banks are Sonali Bank, Janata Bank, Agrani Bank, Rupali Bank, BAS

42m ago