স্বাভাবিক হয়নি পটুয়াখালীর ৭৫ ইউপির কার্যক্রম, আত্মগোপনে অনেক চেয়ারম্যান

পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস পার হলেও এখনো পটুয়াখালীর ৭৫ ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। হামলা-মামলা, হয়রানির ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক জনপ্রতিনিধি। 

অনেকে হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আবার কেউ তাদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে জনরোষ থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে আছেন। জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে বঞ্চিত ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতাবলে ভোটারবিহীন নির্বাচনে পটুয়াখালীর প্রায় সব ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যান, সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। 

ক্ষমতায় থাকাকালে প্রত্যেকেই পদের প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় রাজত্ব কায়েম করেন। দলীয় এসব চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের জড়িয়েছেন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে।

পটুয়াখালী জেলার ৭৫টি ইউনিয়ন পরিষদের ৪-৫টি ছাড়া প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানই আওয়ামী লীগ মনোনীত। 

সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। সরকার পতনের পর তিনি ইতালিতে পাড়ি জমিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সেখানে তার বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে। 

পটুয়াখালী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফফাত আরা জামান ঊর্মি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, হুমায়ুন কবির এলাকায় না থাকায় প্যানেল চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবুও ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। যারা আছেন তারা শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া ছোটবিঘাই ও বড়বিঘাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করে প্যানেল চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মরিচবুনিয়া ইউপি চেয়ারম্যানকে অপসারণ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব অর্পণের প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। 

লাউকাঠী ইউপি চেয়ারম্যান ইলিয়াস বাচ্চুর বিরুদ্ধে ৯ ইউপি সদস্য দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। 

এ ছাড়া কোথাও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সমস্যা নেই বলে জানান ইউএনও।

ছোটবিঘাই ইউপি সদস্য সুলতান প্যাদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চেয়ারম্যানের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে হয় না। এখন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ।' 

গলাচিপার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আল হেলাল জানান, উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাই এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে দুয়েকটি ইউনিয়নের ইউপি সদস্যরা তাদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ দিচ্ছেন। 

লিখিত অভিযোগ পেলে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ইউএনও।

দশমিনা উপজেলার ৭টি ইউপির মধ্যে ২৭ আগস্ট বহরমপুর ও ৪ সেপ্টেম্বর দশমিনা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে অনুপস্থিতির কারণে অপসারণ করে দশমিনা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাফিসা নাজ নিরা। 

দুমকির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহীন মাহমুদ জানান, উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে লেবুখালী, আঙ্গারিয়া ও মুরাদিয়া ইউপির চেয়ারম্যান এলাকায় অনুপস্থিত। এসব ইউপিতে প্যানেল চেয়ারম্যানরা দায়িত্ব পালন করলেও জন্ম ও মৃত্যু সনদ নিশ্চিত করতে আইডি ও পাসওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৩ সরকারি কর্মকর্তাকে।

কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম জানান, উপজেলার ১২টি ইউপির ২-৩ জন ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান। 

তিনি বলেন, 'হামলা-মামলার ভয়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সবাই গা ঢাকা দিলেও বিএনপির সঙ্গে রফাদফা করে ২-৪ জন এলাকায় এলেও অফিস করছেন আড়ালে।'

কুয়াকাটা সংলগ্ন লতাচাপলির চেয়ারম্যান আনসার মোল্লা সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হয়ে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান তার স্ত্রী।

লতাচাপলিতে এক ইউপি সদস্য প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান ইউএনও।

রাঙ্গাবালী উপজেলার ৫টি ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান থাকলেও ছোট বাইশদিয়া ও মৌডুবির চেয়ারম্যানকে ইতোমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। 

সূত্র জানায়, বাউফলের ১৫টি ইউনিয়নের ১৫ জন চেয়ারম্যানই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তারা সবাই সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ সমর্থিত আওয়ামী লীগ নেতা ও আত্মীয়স্বজন। সবাই এখন আত্মগোপনে। 

আ স ম ফিরোজের ভাতিজা কালাইয়ার ইউপি চেয়ারম্যান মনির মোল্লা ও চন্দ্রদ্বীপের আলকাস মোল্লা, কনকদিয়ার শাহীন চেয়ারম্যানসহ ৯টি ইউপির চেয়ারম্যানরা হামলা-মামলার ভয়ে এখনো এলাকায় ফিরতে পারেননি বলে জানা গেছে। 

মির্জাগঞ্জ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের একজন চেয়ারম্যান বিএনপি দলীয় হলেও বাকি ৫ জন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। ইতোমধ্যে মাধবখালী ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান লাবলু কাজীকে অপসারণ করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) তন্ময় হালদারকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক নুর কুতুবুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইতোমধ্যে অনেক ইউনিয়নে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিছু ইউনিয়নে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আরও যারা অনুপস্থিত রয়েছেন বা থাকবেন তাদের ব্যাপারেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
 

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

9h ago