নোয়াখালীতে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব, ১৬ শয্যার ওয়ার্ডে ভর্তি শতাধিক

নোয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ড থেকে গতকাল তোলা ছবি। ছবি: স্টার

নোয়াখালীতে বন্যার পর নামতে শুরু করেছে পানি। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়ে ডায়রিয়ার প্রার্দুভাব। আশ্রয়কেন্দ্র ও বাড়িঘরের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া। এ পর্যন্ত ডায়রিয়ায় ২ জন মারা গেছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন সহস্রাধিক।

গতকাল শুক্রবার নোয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ১৬ শয্যা ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন শতাধিক রোগী। হাসপাতালের বেডে জায়গা না হওয়ায় মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। রোগীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা।

হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বৃহস্পতিবার রাত থেকে চার মাসের শিশু তাওহীদকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন বেগমগঞ্জ উপজেলার বাবুনগর গ্রামের সাজেদা আক্তার-নুর উদ্দিন দম্পতি। তারা জানান গত ২০ দিন যাবত শরীফপুর ইউনিয়ন ও আশেপাশের এলাকা কোমর পানির নিচে তলিয়ে যায়। বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে সেখানে ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি পান করেছেন তারা। শিশুর খাবারও ওই পানি দিয়ে তৈরি করা হয়।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাচ্চার পাতলা পায়খানা শুরু হলে সন্ধ্যায় অবস্থার অবনতি হয়। দ্রুত হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ছেলেকে ভর্তি করান।

'ওয়ার্ডে এসে দেখি বেড তো দূরের কথা মেঝেতেও এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। কোনোরকম মেঝেতে ব্যবস্থা করে বাচ্চার চিকিৎসা চলছে,' বলেন তারা।

সদর উপজেলার স্থানীয় হেরাঙ্গীর পোল এলাকার বাসিন্দা মো. মানিক মিয়ার মেয়ে আয়েশা আক্তার (২৫) ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার সকালে ভর্তি হয়েছেন। জানান, গতকাল ওয়ার্ডে চিকিৎসক আসেননি। হাসপাতাল থেকে ওষুধ সরবরাহ করেনি। বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে।

সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. রাহেত (২২) বলেন, তার স্ত্রী কামরুন নাহার (১৮) বাড়িতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালে রোগীর এতই ভিড় যে মেঝেতেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না।

নোয়াখালী সরকারি কলেজের পুরাতন কলেজ ভবন আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে এসেছেন বেগমগঞ্জের অনন্তপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন (৫৫)। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে তীব্র গরম, নোংরা পরিবেশ ও সেখানকার টয়লেট ব্যবহার করে এবং বিশুদ্ধ পানি পান করতে না পেরে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।

একলাশপুর গ্রামের হারুনুর রশিদের স্ত্রী মারজাহান বেগম (৩৫) জানান, তিনি তার দুই ছেলেসহ পরিবারের চার জন ডায়রিয়ায় আক্তার হয়েছেন। দ্রুত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন তারা।

ডায়রিয়া ওয়ার্ড ইনচার্জ রাজিয়া সুলতানা বলেন শুক্রবার সকালে ১৬ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১২৭ জন রোগী ভর্তি ছিল। এরপর প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর রোগী ভর্তি হচ্ছে। রোগীর চাপে নার্স ও আয়াদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। রোগীদের ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগও সঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন।

জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. নাহিদ হাসান বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে শুক্রবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ২২৯ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। এছাড়া একই সময় ১৪০ জন সাপেকাটা রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন।

মেডিসিন ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ডা. মো. এমরান হোসেন সোহেল বলেন, মেডিসিন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর চাপ অনেক বেশি। আজ শনিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ১৬ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৯১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। পাশাপাশি মেডিসিন ওয়ার্ডে ২৪টি শয্যার বিপরীতে ১৪০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। রোগীর অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে হচ্ছে ডাক্তার, নার্স ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের। জরুরিভিত্তিতে মেডিসিন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে জনবল বৃদ্ধি করার প্রয়োজন।

জেনারেল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ডায়রিয়া ও মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগীর চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। শয্যার তুলনায় ১৫-২০ গুণ রোগী ভর্তি হচ্ছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলায় জরুরিভিত্তিতে একটি ডায়রিয়া ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। সেখানে ৫০ জন ডায়রিয়া রোগী রেখে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ রয়েছে দাবি করে বলেন প্রয়োজনে আরও ওষুধ কেনা হবে। ডাক্তার ও নার্সদের দায়িত্ব অবহেলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

নোয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, ডায়রিয়া পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। ৮টি বন্যাকবলিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শনিবার সকাল পর্যন্ত ১৮৪ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি রয়েছেন। তবে চলতি মাসে বন্যা শুরু হওয়ার পর (৯ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট) ডায়রিয়ায় কত রোগী আক্রান্ত হয়েছেন তা তিনি বলতে পারেননি। ডায়রিয়ায় গত ২৫ আগস্ট বেগমগঞ্জে একজন এবং ২১ আগস্ট সদরে একজন জন মারা গেছেন।

তিনি বলেন, বন্যার্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে ১২৪টি সরকারি মেডিকেল টিম এবং ১৬টি বেসরকারি টিম কাজ করছে।

ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পেতে তিনি বলেন, বন্যা কবলিত এলাকার লোকজন খাবার পানি সংগ্রহ করে যেন সরাসরি পান না করেন। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এছাড়াও খাবার গ্রহণের আগে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত পরিষ্কার করতে বলেন। পাতলা পায়খানা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার স্যালাইন খাওয়া এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে দ্রুত কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার পরামর্শ দেন।  

Comments

The Daily Star  | English

Dengue cases see sharp rise in early July

Over 1,160 hospitalised in first 3 days, total cases cross 11,000

11h ago