আমাদের লক্ষ্য সুবিচার, আওয়ামী আমলের মতো প্রতিশোধ বা নির্যাতন নয়: আসিফ নজরুল

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গঠন করা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মাত্র কয়েকদিন বয়সী হলেও এই সরকারের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।

এই সরকারের একজন উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মধারা, কর্মপরিকল্পনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে গত ২২ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে আইন, বিচার ও সংসদ; প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনারা শপথ নিলেন ৮ আগস্ট, আজ ১৪ দিন হলো। বহু কাজ জমে আছে—এটা আপনারাও বলেছেন, আমরাও জানি। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল: আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং লেখক-সাংবাদিক মানুষ ছিলাম। অনেক সময় থাকতো, ইচ্ছামতো জীবনযাপন করতে পারতাম। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর মনে হয়েছে, এত বেশি দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার হয়ে এসেছে, এতরকমের সমস্যা! দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা করে সপ্তাহের সাত দিনই অফিস করছি—বাসায় ফিরে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছি। তারপরও মনে হচ্ছে, আরও অনেক কাজ করা দরকার।

১৭ বছর পর দেশের মানুষ বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে; মুক্ত ও তীব্র কণ্ঠে দাবি করতে পারছে; স্বপ্ন দেখতে পারছে। সবার মাঝে এত বেশি প্রত্যাশা জমে গেছে যে এর সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে যে চ্যালেঞ্জ, সেটা শারীরিকভাবে খুব কঠিন হয়ে যায়। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি।

ডেইলি স্টার: সরকারের ওপর বিশাল প্রত্যাশার চাপ। এই প্রত্যাশা মেটাতে গিয়ে কী মনে হচ্ছে যে কোনো কোনো জায়গায় আপনারা হিমশিম খাচ্ছেন বা যেটা করা উচিত না এমন কিছু হয়ে যাচ্ছে?

আসিফ নজরুল: সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই নেই। যেকোনো মানুষ যদি স্বল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো কাজ করতে যায়, তার কিছু ভুল হবে। কিন্তু দেখতে হবে আমার ভালো কিছু করার সদিচ্ছা আছে কি না, পরিশ্রম করছি কি না, ভুল থেকে শেখার চেষ্টা করছি কি না।

আমি মনে করি, আমাদের এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভুল থেকে শেখার চেষ্টা করছে। কোনো ভুল হলে আমাদের উপদেষ্টা পরিষদে, এমনকি ইউনূস স্যার লাঞ্চের সময়ও এসব নিয়ে আলোচনা করেন। কিছু কিছু ভুল তাৎক্ষণিকভাবে শোধরানো সম্ভব হয়, কিছু হয়তো না।

গোপনীয়তার শপথ নিয়েছি বলে সবকিছু বলতে পারব না, কিন্তু এটা নিশ্চিত করতে পারি যে ভুলগুলো সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকার চেষ্টা করি। কতটুকু শিখতে পারছি বা কত দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছি, সেখানে আমাদের ঘাটতি থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিদিন আমরা শিখছি এবং নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করছি। জনগণ কী ভাবে, সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি এবং আশা করি ভবিষ্যতে আরও ভালো করব।

তবে, ১৫ বছরের ব্যর্থতা-পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ১৫ দিনের শিশু সরকার কতটা মেটাতে পারবে, সেটাও সবাইকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনায় রাখতেও অনুরোধ করব।

ডেইলি স্টার: ড. ইউনূস, আসিফ নজরুলদের মতো যেসব পরিচিত মুখ এই সরকারে আছে, তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে, তারা ম্যাজিক দেখাবেন। এই প্রত্যাশা পূরণ করবেন কীভাবে?

আসিফ নজরুল: মানুষের কাছে যখন হঠাৎ করে এত বড় একটা সুযোগ আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ম্যাজিক দেখতে চায়। এখানে আমাদের সমাজে যারা প্রাজ্ঞ মানুষ আছেন, যারা রাষ্ট্র বোঝেন—তারা মানুষকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করলে ভালো হয়। নিজেদের কথা যদি বলি, আমাদের ভুল হচ্ছে কিছু। তবে আমাদের মধ্যে তরুণ সমন্বয়ক যারা আছেন, যাদের সঙ্গে কাজ করছি, তাদের কাজ দেখে আমি মুগ্ধ। সত্যিই তারা খুবই দক্ষ ও পরিণত। আমরা তাদের মাধ্যমেও বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি। আবার সমাজের বিভিন্ন অংশে যখন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, সেখান থেকেও মানুষ বোঝে। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করছি।

তবে একটা জিনিস বুঝতে হবে, মানুষের পক্ষে রাতারাতি ম্যাজিকাল কোনো কিছু করা সম্ভব না। মানুষের পক্ষে বাস্তবসম্মত ভালো কাজ করা সম্ভব।

ডেইলি স্টার: এইচএসসি শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় করে নেওয়ার পর সমাজে দুই ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে। একটি হচ্ছে, সরকার অত্যন্ত নরম, তারা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে দুর্বলতার পরিচয় দিলো। অপরটি হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এখনো ট্রমার মধ্যে আছে, তাই তাদের দাবি মানা হলো। কিন্তু দিনশেষে শিক্ষার ক্ষেত্রে গত ১৭ বছরে যে অধঃপতনের ধারা তৈরি হয়েছে, সেই একই ধারায় থাকলাম কি না। মানুষের কাছে কী বার্তা যাবে?

আসিফ নজরুল: প্রথম কথা হচ্ছে, সরকার দুর্বল না; সরকার সহৃদয়, সহানুভূতিশীল। এই আন্দোলন যারা করেছে, তারা কী ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে সেটা দেখতে হবে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও কিন্তু এই আন্দোলনের অংশ। আপনারা জানেন, মুক্তিযুদ্ধের পরও এমন ট্রমার মধ্যে ছিলেন পরীক্ষার্থীরা। আমরা এখনো তাদের সেই ট্রমাকে বিবেচনায় নিয়েছি, এটা আমাদের দুর্বলতা না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, পরীক্ষা বাতিল ভালো নজির না।

ডেইলি স্টার: বিচার বিভাগের কথা বলা হচ্ছে, এখানে অনেক সংস্কার করা হবে? সেটা সম্ভব, করতে পারবেন?

আসিফ নজরুল: এটাকে অসম্ভব ব্যাপার মনে হয়নি আমার কাছে। আমি আইনের শিক্ষক, নিম্ন আদালতে যে বিচারকরা আছে, তাদের একটি বড় অংশ আমার সরাসরি শিক্ষার্থী। উচ্চ আদালতে যারা বিচারক আছেন, তাদের অন্তত অর্ধেক আমার কলিগ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত। আমি কনসালটেন্ট হিসেবে জুডিশিয়াল রিফর্মের জন্য এডিবি-ইউএনডিপিতে কাজ করেছি। আমি আত্মবিশ্বাসী যে নিয়ত ভালো থাকলে অবশ্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব।

আমাদের বিচার বিভাগের সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে—ডোনাররাও বলে, সুশীল সমাজও বলে—নিম্ন আদালতকে স্বাধীন করতে হবে। আসলে নিম্ন আদালত না, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে আগে উচ্চ আদালত ঠিক করতে হবে।

নিম্ন আদালত স্বাধীন করার মানে হচ্ছে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ উচ্চ আদালতের কাছে দেওয়া। উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করবে, সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু উচ্চ আদালতই যদি সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে, তাহলে নিম্ন আদালতকে উচ্চ আদালতের হাতে ছেড়ে দিয়ে লাভ কী?

আমরা এটা নিয়ে কাজ করেছি। প্রথমে উচ্চ আদালতে সংস্কার করতে হবে। উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ভয়াবহ নৈরাজ্য ঘটে গেছে। কিছু ভালো নিয়োগ হয়েছে, কিন্তু অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও চরম দলবাজ কিছু ব্যক্তিকেও সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আপনারা জানেন, এক সময়ের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত এটা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

এই নিয়োগ-নৈরাজ্য বিএনপির সময়ও হয়েছে। তবে বিনা নির্বাচনে-ভুয়া নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সময়ে এই নৈরাজ্য সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

উচ্চ আদালতে সংস্কারের উপায় হচ্ছে, নিয়োগ আইন, নিয়োগ পদ্ধতি ঠিক করা; প্রধান বিচারপতি অসীম একক ক্ষমতা উপভোগ করেন, এটাকে যুক্তিযুক্ত করা; উচ্চ আদালতের জিএ কমিটি আছে, সেটাকে পুনর্গঠন করা; উচ্চ আদালতকে স্বাধীন একটি সচিবালয় দিয়ে দেওয়া; অবসর পরবর্তী সময়ে সেখানকার বিচারপতিদের কোনো পদে নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ করা।

এমন কিছু কাজের মাধ্যমে এই সংস্কার অবশ্যই সম্ভব। নিয়োগের কথা যদি বলি, আপনি আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে দেখেন। তিনি অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা করা, টাফট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা। আর আগের অধিকাংশ প্রধান বিচারপতি ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে আসা। এই পার্থক্যটা দেখেন। অক্সফোর্ড থেকে পাস করা এই মানুষটা কি কারো মানসিক দাস হবে? তার তো আত্মমর্যাদা আছে, জ্ঞান আছে। আর কম যোগ্য ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি হন বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক আনুগত্য দেখিয়ে দেখিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তার চিন্তা ভিন্ন হবে।

ডেইলি স্টার: আপনারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকবেন। এই সময়ের এসব বাস্তবায়িত সিদ্ধান্ত স্থায়ী হবে কীভাবে?

আসিফ নজরুল: এটা একটা উদাহরণ তৈরি হলো। ভবিষ্যতে যখন বিচারপতিরা নিয়োগ পাবেন, তখন আপনারাও সবাই এর সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, আমরা পদ্ধতি পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি। যদি এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করা যায় যে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ পাবেন দক্ষতা ও সততার ভিত্তিতে। সেখান থেকে পরবর্তীতে আপিল বিভাগ ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হবে। আমরা পদ্ধতি তৈরি করতে পারি, কিন্তু সেই পদ্ধতি শতভাগ নিশ্চয়তা দেবে না যে সবাই ভালো হবে। তবে এটা বলতে পারি যে এই পদ্ধতি নৈরাজ্যতা কমিয়ে আনতে পারবে। উচ্চ আদালত ঠিক করার পর নিম্ন আদালতের বিষয়ে আমরা কাজ করব। বিচার বিভাগ মানুষের শেষ ভরসাস্থল। এই জায়গাটা ঠিক থাকলে মানবাধিকার, আইনের শাসনসহ বহু বিষয়ে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

ডেইলি স্টার: দীপু মনিদের—আদালতে যাদের নেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর হামলা হতে দেখা গেল। এটাকে বলা হচ্ছে যে সরকার তাদের নিরাপত্তা দিলো না বা দিতে পারলো না। এটা ছোট ঘটনা মনে হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এর বড় প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

আসিফ নজরুল: অনেক মানুষের কাছে, বিশেষ করে দীপু মনির ঘটনা খারাপ লেগেছে। আমারও খারাপ লেগেছে। কিন্তু আদালত পাড়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটার প্রধান দায় কি সদ্য সাবেক সরকারের না? তারা ১৫ বছর যাবত বিচারের নামে যে নৈরাজ্য করেছে, মানুষকে নিষ্পেষিত করেছে, ফরমায়েশি রায় দিয়েছে, দেশের মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং সরকারের মন্ত্রীরা যে ধরনের ভূমিকা রেখেছে; এক কথায় সরকার মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে, মানুষকে গণহত্যার শিকার বানিয়ে এমন একটা রাষ্ট্র তৈরি করেছে, সেখানে সব মানুষ অত্যন্ত বিনয়ী আচরণ করবে সেটা আমরা আশা করতে পারি, কিন্তু নিশ্চিত করতে পারি না।

যে পরিবারের কেউ গুম হয়েছে; বিচার-বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে; যে ছেলেগুলো চাকরি, ব্যবসা, ধন সম্পদ হারিয়ে বহু বছর ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে; আওয়ামী লীগের লোক নয় বলে আদালতে সুবিচার পায়নি; আইনজীবীরা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হার্ট-অ্যাটাক করে মারা গেছেন; অন্য আইনজীবীরা উচ্চ আদালতের অত্যন্ত বিতর্কিত একজন বিচারকের রোষানলের শিকার হয়েছেন, এই যে ১৭ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, যন্ত্রণা, কষ্ট—এটার বিস্ফোরণ হয়। এই বিস্ফোরণ বাঞ্ছনীয় না, কিন্তু অস্বাভাবিকও না।

আমরা মনে করি এগুলো ঠেকানোর ক্ষেত্রে শুধু আমাদের সরকার নয়, সমাজের সবার ভূমিকা রয়েছে। সবাই মিলে এগুলো বন্ধ করতে হবে। বিচার মানে বিচার; এটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

ডেইলি স্টার: আমরা সব সরকারের কাছেই শুনি যে আগের সরকার খারাপ করেছে…

আসিফ নজরুল: যে সরকার দুই সপ্তাহে প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, শিশুদের বুকে গুলি করেছে, যে সরকার ছাত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে, রাতে ব্লক রেইড করে শিক্ষার্থীদের ধরেছে—সেই সরকারের প্রসঙ্গ যদি না টানি, তাহলে সেটা পাপ হয়। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে এসেছি গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে। আমি মনে করি, আমাদের উচিত উঠতে বসতে আওয়ামী লীগ সরকার কী করে গেছে তা স্মরণ করা। এটা বলতে হবে ভালো কিছু করার প্রত্যায়কে জাগ্রত রাখার জন্য, মানুষের বুকের ক্ষতের গভীরতা বোঝার জন্য, সে অনুসারে কর্তব্যকর্ম পালন করার তাগিদ জোরালো রাখার জন্য।

ডেইলি স্টার: সবক্ষেত্রে ব্যাপক রদবদল হচ্ছে। সংস্কার মানে কী? সংস্কার মানে কি শুধুই রদবদল?

আসিফ নজরুল: সংস্কারের আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে এই ১৫-১৬ বছরে যারা একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে, তাদের হাত থেকে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশসহ সবকিছুকে বের করতে হবে। যে মানুষ বিচার-বহির্ভূত হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে, তাকে তার জায়গায় রেখে কি সংস্কার করতে পারবেন? আবার আপনি কি ডিবির হারুনকে রেখে পুলিশে সংস্কার করতে পারবেন? এই মানুষগুলোকে সরিয়ে এমন মানুষকে আনতে হবে, যে একই সঙ্গে সৎ ও যোগ্য।

এই লোকগুলোকে আনার পর আমরা আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলো সংস্কার করব। যেমন: আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় থেকে প্রথমে আমরা জুলাই হত্যাকাণ্ডে যেসব ভুয়া মামলা করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার করার ক্ষেত্রে আমাদের যতোটুকু ভূমিকা তা পালন করেছি। এরপর আমরা নীতি ও আইনের বিষয়ে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করব, যাতে ভবিষ্যতে এমন আর না হয়। কিন্তু প্রথমে তো আমাকে যোগ্য ও দক্ষ লোকগুলোকে বসাতে হবে, যাতে অন্যায়ের ধারাবাহিকতা না থাকে।

সংস্কার মানে কেবল যোগ্য লোককে বসানো নয়। যোগ্য লোককে বসানো হচ্ছে যাতে সংস্কারের প্রক্রিয়াকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। সংস্কারের মানে হচ্ছে প্রশাসনে পরিবর্তন আনা, গণমুখী করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক করা, স্বচ্ছ করা ও জবাবদিহি করা। সেটা আমরা অবশ্যই করব।

আর বাংলাদেশে সংস্কার ভাবনার মধ্যে নতুন কিছু খোঁজার অবকাশ কম। এটা নিয়ে বহু কাজ ইতোমধ্যে হয়েছে। ১৯৯১ সালে তিন জোটের রূপরেখা করা হয়েছে। সেই আশি-বিরাশি সালে সিরাজুল আলম খানরা সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সুজন, সিপিডি, টিআইবি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, অধিকারের মতো বহু প্রতিষ্ঠানের লিখিতভাবে সংস্কার ভাবনা রয়েছে। সবই আছে আমাদের ছিল না কেবল সদিচ্ছা, নেতৃত্ব। এখন আমরা এমন একজন মানুষকে নেতা হিসেবে পেয়েছি, আমার ধারণা আমরা কিছু ভালো কাজ করে যেতে পারব।

ডেইলি স্টার: আগের সরকারের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু যে মানুষটার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেশের আর্থিকখাত ধ্বংস করে দেওয়ার, তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে হত্যায় প্ররোচনা বা নির্দেশ দেওয়ার মামলায়। এমন আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের সময়ও আমরা বহু হাস্যকর মামলায় মানুষকে আসামি করতে দেখেছি। এখনো প্রতিদিন একাধিক মামলায় আগের সরকারের ও সরকারি দলের লোকদের আসামি করা হচ্ছে। পুলিশ কি সেই আগের ধারাতেই হাস্যকর মামলায় আসামি করতে থাকবে, নাকি পুলিশকে আপনারা বদলে দিতে পারবেন?

আসিফ নজরুল: এখনকার মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়তো হতে পারে, কিন্তু তা হাস্যকর না। কারণ, শেখ হাসিনার নামে মাছ চুরির মামলা তো দেওয়া হয়নি, যেটা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নামে দেওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে হত্যার। জুলাই হত্যাকাণ্ডে সন্তান হারিয়ে মামলা করেছেন; তারা যদি মনে করেন এই হত্যাকাণ্ডের দায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর, সেটা কি বিতর্কিত মামলা হয়? যদি আমার সন্তান মারা যেত, আমি-ই ধরে নিতাম এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ওই প্রধানমন্ত্রী দায়ী, ওবায়দুল কাদের দায়ী। এটা কি তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে?

আমি যতটা বুঝতে পারি, আর্থিকখাতের মামলায় প্রস্তুতি লাগে, সময় লাগে। তার আগে আওয়ামী লীগের একজন জনধিক্কৃত মন্ত্রীর জন্য কোনটা নিরাপদ—সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় চলা নিরাপদ, নাকি আটক থাকা নিরাপদ—এসব হয়তো কারো কারো বিবেচনায় থাকে।

আবার কিছু মামলার ক্ষেত্রে এমন শুনেছি যে থানা ঘেরাও করে স্থানীয় কোনো অপরাধী বা অত্যাচারী রাজনীতিবিদের নামে মামলা নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। তবে মামলা নেওয়ার অর্থ তো কাউকে শাস্তি দেওয়া না। মামলা আমলে নেওয়ার পরও তো তদন্ত হতে পারে, অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে থাকতে পারে। এটা তো আওয়ামী আমলের মতো হবে না, যেখানে লক্ষ্যই ছিল মামলার জালে আটকে ফেলা, জামিন না মঞ্জুর করে আটকে রাখা।

ডেইলি স্টার: সারা দেশে শত শত মামলা হয়ে গেলে সেটা বিচার প্রক্রিয়ার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে কি না?

আসিফ নজরুল: দেশের কোনো প্রত্যন্ত এলাকাতে একজন সন্তানহারা পিতা যদি মামলা করতে চান, তাকে বাধা দেওয়ার বা বারণ করার অধিকার ড. ইউনূস বা আমাদের নেই। জুলাই হত্যাকাণ্ডে—শুধু হত্যাকাণ্ড না, এখানে হাজারো মানুষ গুলিবিদ্ধ, চোখ হারিয়েছে, গুরুতর আহত হয়েছে—প্রত্যেকটা মানুষ যদি হুকুমদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা বা তার সরকারের মন্ত্রীদের আসামি করে মামলা করে, আমরা তো কাউকে নিবৃত করতে পারব না। আমরা কাউকে মামলা করতে উৎসাহিত করছি না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ মামলা করছে। আমরা শুধু নিশ্চিত করব, বিচার যেন ঠিকমতো হয়। সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে সরকারের দায়িত্ব।

হত্যার বিষয়ে অনেক মামলা হতে পারে। ধরেন, কোনো একজনের বিরুদ্ধে ৫০টা হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হয়তো দুই বা তিনটি প্রমাণিত হয়ে গেছে। বাকিগুলো যদি প্রমাণিত না-ও হয়, তারপরও বিচারের যে উদ্দেশ্য—দোষীর শাস্তি পাওয়া—সেটা বাস্তবায়ন হবে এবং ভুক্তভোগীদের মনের যে ক্ষত সেটা খানিকটা নিরাময় হবে। আর যদি বিচারিক প্রক্রিয়ায় সবগুলো মামলায় সে ছাড়া পায়, তাহলে পাবে। মানুষের মধ্যে অন্তত এতটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা গেছে।

ডেইলি স্টার: জুলাই হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড নয়। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডটা যদি পরিকল্পিত হয়, গণভবনে বসে যদি পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়, ছাত্রলীগ-যুবলীগের হাতে অস্ত্র দিয়ে যদি পুলিশের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মানুষ হত্যা করতে; তাহলে মামলা বা বিচারিক প্রক্রিয়াটা কেন পরিকল্পিতভাবে করা সম্ভব হবে না?

আসিফ নজরুল: এটা পরিকল্পিত বা গোছানোভাবে তখন হবে, যখন সরকার অ্যাকটিভলি এই মামলা প্রক্রিয়ার অংশ হবে। এটা তদন্ত শুরুর আগের পর্বে ততটা সম্ভব না। এ জন্যই আমি বলেছিলাম, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা দেওয়া যেতে পারে। এটা আমরা দেখছি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিশ্ব গৃহীত সংজ্ঞা হচ্ছে, যদি পরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত ও পদ্ধতিগত হত্যা হয় সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। এসব অভিযোগের তদন্ত আমরা ভালোভাবে করতে পারব। তারপর বিচার কী হবে সেটা বিচারকের ব্যাপার। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সুবিচার, আওয়ামী আমলের মতো প্রতিশোধ বা নির্যাতন নয়।

ডেইলি স্টার: যাত্রাবাড়ীর একজন শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় সাত সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। এ ধরনের মামলা বিগত সরকারের সময়ে দেখা গেছে। এখনও কেন এমন মামলা হচ্ছে?

আসিফ নজরুল: একজন খুন হওয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবককে তার বিচার বিবেচনা মতো মামলা করা থেকে আমরা বিরত রাখতে পারি না। এ রকম ঢালাও মামলা করা বিগত সরকার একটি প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিতে পরিণত করেছিল। হয়তো এর রেশ দেখছি এখন। তবে আমরা দেখবো, যাতে যথাযথ তদন্ত ছাড়া কেউ হয়রানির শিকার না হন।

ডেইলি স্টার: আপনাদেরকে সতর্কও করা হচ্ছে। আলী রীয়াজ তার কলামে আপনাদেরকে সতর্ক করেছেন, বিচার প্রক্রিয়া যেন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। এই কথা বলতে হচ্ছে কেন? এর তাৎপর্য কী?

আসিফ নজরুল: বিনয়ের সঙ্গে বলি, আমি আলী রীয়াজের কিছু ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত না। যেমন: আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রসঙ্গ। তবে তার বা বৃহত্তর সুশীল সমাজের সমালোচনাকে আমি স্বাগত জানাই। সুশীল সমাজের দৃষ্টি প্রতিটি সরকারের ওপর থাকা দরকার। সুশীল সমাজ সবসময় সৎ উদ্দেশ্যে সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করে। আমিও এরই অংশ ছিলাম। এখন সরকারে এসে দেখতে পাচ্ছি, এ পর্যন্ত যা হয়েছে সেখানে এতটা উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো কিছু সম্ভবত হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওনাদের পরামর্শ অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। আবার মাঝে মাঝে এটাও মনে হয়, ওনারা কি এটা বিবেচনায় এনেছেন যে ১৫টা বছর ধরে এই পুলিশ, বিচারব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দলবাজি, ব্যক্তিপূজা ঢোকানো হয়েছে; সেই প্রশাসনকে দিয়ে ১৫ দিন বয়সী একটা সরকার সম্পূর্ণ বিতর্কমুক্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, এটা কি সম্ভব?

ডেইলি স্টার: ওনারা দেখতে চাচ্ছেন যে আপনারা সেই পথে আছেন কি না।

আসিফ নজরুল: সেই পথে আমরা আছি কি না, সেটা ওনারা দেখবেন। আমরা কোথাও হোঁচট খেলে, ভুল হলে তারা সমালোচনা করবেন, সেটা আমরা চাই। কিন্তু তারা যেন উৎকণ্ঠা প্রকাশের সময় এই বৃহৎ বিষয়টি মাথায় রাখেন যে বিগত সরকারের আমলে সবকিছু পচিয়ে ফেলা হয়েছে; এই পচে যাওয়া জিনিস থেকে আমি কতটা ভালো জিনিস বের করতে পারব। এর জন্য আমাদের সময় লাগবে।

ডেইলি স্টার: আপনার কি মনে হয় না যে এই সরকারকে নিয়ে উৎকণ্ঠার অনেক ব্যাপার আছে? ছাত্র-জনতার একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ফসল এই সরকার। বলা হয়েছে যে এই সরকারের বিরুদ্ধে একটি জুডিশিয়াল ক্যু হতে যাচ্ছিল—সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। এটা মানুষকে উৎকণ্ঠিত করে। যখন একজন সামরিক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়, উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হয় এবং তাকে নিয়ে নানা রকম গল্প প্রচার করা হয়, তখন এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করতে গিয়ে যা করা হচ্ছে সেটা নিয়ে একধরনে উৎকণ্ঠা তৈরি হচ্ছে, আবার তাদের শোক পালন করতে না দেওয়ার ফলেও এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে।

আসিফ নজরুল: উৎকণ্ঠা সবসময় প্রকাশ করা উচিত। এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক পথ সৃষ্টি করবে। উৎকণ্ঠা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কেউ যদি তাড়াতাড়ি সব চান, আর প্রত্যাশাটা যদি যৌক্তিক প্রেক্ষাপট থেকে না করা হয়, যৌক্তিকভাবে না করা হয়, সেটা সমাজের কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।

টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ায় আমাকে অনেকে চেনেন। রাস্তায় রাস্তায় আমার গাড়ি থামিয়ে মানুষ তাদের দাবিগুলো বলতে থাকেন। আমাকে কয়েকদিন আগে ঘিরে ধরলেন তথ্য আপারা। তাদের দাবি, প্রকল্প থেকে তাদেরকে রাজস্বখাতে আনতে হবে। তাদের বললাম, আপনাদের নিয়োগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ আমলে। সেই সরকারের কাছ থেকেই গত ১১ বছরে এই দাবি আদায় করতে পারেননি, আর এই ১১ দিনের সরকারের কাছে যে দাবি করছেন, সেটা কি যৌক্তিক? প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ঘেরাও করে রাখায় ড. ইউনূস ৬৫টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সভায় পৌঁছালেন আড়াই ঘণ্টা দেরি করে, এটা কি যৌক্তিক? দেশবাসীর কাছে বলব, এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা যেভাবে সচিবালয় ঘেরাও করে তাদের দাবি আদায় করে নিলো, এটা কি যৌক্তিক? ১৭ বছরের বঞ্চনার পর বাকস্বাধীনতা ফেরত পেয়ে ১৭ দিনের সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের জন্য রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাখা এবং বলা যে কেন আমরা স্বাধীন করলাম, এটা কি যৌক্তিক? এর সবই আপনাদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম।

আপনাদের দাবি থাকলে সেটা পেশ করেন, একটা যৌক্তিক সময়সীমা দেন এবং সেই সময়ের মধ্যে কাজ না হলে প্রতিদিন এক ঘণ্টা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন, সারাদিন রাস্তা দখল করে রাখলে তা ঠিক হবে না।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের সম্পদের প্রচণ্ড ঘাটতি আছে। আওয়ামী লীগ সরকার ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছে, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে, ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করে গেছে। আমি তো জানি সরকারের আর্থিক অবস্থা কেমন। এখন সবাই যদি বলে, এতদিন আমরা প্রকল্পে ছিলাম, আমাদের এখনই রাজস্বখাতে নিয়ে যান, সেটা কি সম্ভব?

আমাদের কাছে প্রত্যাশা করেন, কিন্তু সেটা আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে নয়, সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে নয়। ছাত্র-জনতার বিপ্লব বেহাত হতে পারে এমনভাবে কিছু করবেন না, এটা আমার অনুরোধ।

ডেইলি স্টার: সংস্কার করতে সময় লাগবে এবং সংস্কার করে তারপর নির্বাচন—আপনাদের এই কথাটা অনেকে বুঝতে পারছে না।

আসিফ নজরুল: এই সরকারের মেয়াদ কতদিন সেই সিদ্ধান্ত আমরা এখনি নিতে পারি না। এই সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের মানুষ। কথাটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেন, দেশের অন্যতম একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি বলে গেছে, যতদিন সময় লাগে আমরা দেখব। আমাদের সঙ্গে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর কথা হয়েছে, কেউ বলেনি যে এতদিনের মধ্যে আপনারা চলে যান। আপনি যদি সংস্কার চান এবং আপনি যদি চান যে আগামী নির্বাচন এমন একটি প্রশাসনের অধীনে হবে যারা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে, তাহলে সেটা নিশ্চিত করার জন্য এই সরকারকে সময় দিতে হবে।

ডেইলি স্টার: এটা কি আপনাদের বলতে হবে না যে এতদিন সময় লাগবে?

আসিফ নজরুল: আমরা একপর্যায়ে গিয়ে এটা নিয়ে বসবো যে কতদিন পরে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। সেটা একটু সময়সাপেক্ষ। কিন্তু, এই মুহূর্তে আমাদের জরুরি যেগুলো করণীয় সেটা আগে করতে হবে। কোথাও আগুন লাগলে আগে তো আগুন নেভাতে হবে। সেটাকে আবার কীভাবে নতুন করে গড়বো, তা পরে ভাবতে হবে।

আমরা প্রথম যে কাজটি শুরু করেছি সেটা হলো, যেন কোনো প্রতিবিপ্লব না হয়, কোনো ষড়যন্ত্র না হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপ্লব হয়েছে, প্রতিবিপ্লব হয়েছে।

ডেইলি স্টার: প্রতিবিপ্লব হিসেবে জুডিশিয়াল ক্যু কি সত্যিই হতে যাচ্ছিল?

আসিফ নজরুল: যেহেতু ঘটেনি, তাই সত্যটা কী তা আমরা জানি না। তবে, এমন কিছু হওয়ার আশঙ্কা করার কারণ ছিল। আমাদের প্রাধান্য হচ্ছে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা, মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করা, প্রশাসন-পুলিশকে জনবান্ধব করা।

ডেইলি স্টার: আর্থিকখাত রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? প্রথমত, পাচার যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করা এবং দ্বিতীয়ত, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা। এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন কি না? বড় বড় পাচারকারীদের ধরার সক্ষমতা আপনাদের আছে কি না?

আসিফ নজরুল: হ্যাঁ, আমরা পাচাররোধে প্রস্তুতি নিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গায় যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের দেখেও কি মনে হচ্ছে না যে আর্থিকখাতে অনিয়ম বন্ধে আমাদের নিয়তটা কেমন? বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার পর আহসান এইচ মনসুরের নেওয়া ব্যবস্থাগুলো কি দেখছেন না?

সক্ষমতার প্রশ্ন করলে বলব, এই বিষয়টা আমি কম বুঝি। এটা বলতে পারি যে সক্ষমতা নিয়ে একটুখানি উৎকণ্ঠা থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের নিয়ত নিয়ে কোনো উৎকণ্ঠা রাখবেন না।

ডেইলি স্টার: সরকারের কার্যক্রমে দেখে অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই সরকার কি গতিশীল? সরকারের সব শাখা কি একসঙ্গে কাজ করতে পারছে?

আসিফ নজরুল: আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সবাই কি মেসি? ফ্রান্স ফুটবল দলের সবাই কি এমবাপ্পে? যত বড় দলই হোক, প্রতিটি খেলায় সবাই কি সমন্বয়ের সঙ্গে খেলতে পারে? এখানে আমাদের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই, সমন্বয়ের হয়তো কিছুটা ঘাটতি আছে। আমার সহকর্মী সবার মধ্যে আমি আন্তরিক সদিচ্ছা দেখি। তবে, একেকজনের কাজ করার ধরন একেক রকম। কারো কাজ দেখলে হয়তো মনে হবে যে তিনি অনেক কাজ করছেন, কারো কাজ হয়তো বুঝতে পারি না, তারা নীরবে কাজ করেন।

ফুটবলে দেখেন, মধ্যমাঠের বা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের কথা আমরা কম বলি। আলোচনায় থাকে সেই খেলোয়াড়, যারা গোল দেয়। এই বিষয়টি সবক্ষেত্রেই ঘটে। হয়তো পরিচিত মুখ বলে আমার কাজটা আপনাদের চোখে পড়ছে, কিন্তু ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বা ফাওজুল কবীরের কাজ চোখে পড়ছে না। তারাই হয়তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করছেন, কিন্তু সেভাবে বলছেন না।

ডেইলি স্টার: আপনি নাগরিক সমাজের মানুষ ছিলেন। এখন সরকারে আছেন। এই পরিবর্তনটা কীভাবে হচ্ছে?

আসিফ নজরুল: আমার পরিশ্রমটা বেশি হচ্ছে। আমার প্রিয় কাজ রিকশায় ঘোরা, টেনিস খেলা, পলাশীর বাজারে গিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে গল্প করা, বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো, আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা। এই কাজগুলো এখন আর করতে পারছি না। কিন্তু মানুষের কাছে কাজের প্রশংসা পাচ্ছি, ভালোবাসা পাচ্ছি।

তবে এটাও মনে হয়, আমি তো অন্তত প্রশংসা পাচ্ছি, আমার স্ত্রী কি পাচ্ছে? আমার স্ত্রী আমাকে কয়েকঘণ্টা না দেখলেই অস্থির হয়ে যেত। আর এখন দিনের পর দিন যাচ্ছে, প্রতিদিন হয়তো আমাকে এক পলক দেখে। আন্দোলনের সময় আমি চারটা রাত আত্মগোপনে ছিলাম। সেই চারটা রাত সে ঘুমাতে পারেনি, সারা রাত কেঁদেছে, দোয়া করেছে। আমরা কেউ এই ট্রমাটা দেখি না। এখন তার জীবন বদলে গেছে, আমারও। সংসারের সব কাজ তাকে এককভাবে করতে হচ্ছে। উপদেষ্টা হিসেবে আমার কাজটা হয়তো প্রশংসিত হবে, কিন্তু তারটা কেউ জানবে না।

ডেইলি স্টার: যাদের আন্দোলনের কারণে আপনারা এই জায়গায় এসেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটা করতে পারছেন, বলা হচ্ছে যে তারা এক ধরনের ডিকটেট করছে সব কাজে এবং তাদের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে, বহু কিছু করে ফেলার চেষ্টা করছে। তাদের ওপর আপনাদের নিয়ন্ত্রণ বা তাদের বোঝাতে আপনাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি? তাদের প্রতি আপনার কোনো বার্তা আছে কি না।

আসিফ নজরুল: এই ছাত্র আন্দোলন যারা করেছে তাদের মধ্যে আমরা ছয় সমন্বয়কের কথা বলি। এ ছাড়া, আরও অনেকের বড় ভূমিকা ছিল। এই ছয় সমন্বয়কের কথা যদি বলি, আমি তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখি না, তাদের ম্যাচিউরিটি অবিশ্বাস্য, চেতনাবোধ অবিশ্বাস্য। আর অন্য যারা সরকারের সঙ্গে কাজ করছে না, দূর থেকে সঙ্গে আছে, তাদের ভেতরে কিছুটা অস্থিরতা থাকা স্বাভাবিক। দূর থেকে তারা বুঝতে পারছেন না যে সরকারের আন্তরিকতা কতটুকু, পরিশ্রম কতটুকু।

সবার প্রতি আমার শুধু একটাই অনুরোধ থাকবে, আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে মানুষের ভোগান্তি হয়; যে ছবি দেখে মানুষের মনে হয় যে এটা আমরা দেখতে চাইনি, দীপু মনির ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে। আপনারা একটু ধৈর্য ধরেন। মাঝে মাঝে শুনি এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, শিক্ষকদের তালিকা করা হচ্ছে, সাংবাদিকদের তালিকা করা হচ্ছে—এগুলো দয়া করে করবেন না।

আমাদের ছাত্ররা তো সুগঠিত কোনো রাজনৈতিক দল না। আমাদের প্রধান সমন্বয়কদের মধ্যে দুএক সময় অসহায়ত্ব দেখি। সবকিছু কি তাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? কিন্তু তাদের আন্তরিকতা নিখাদ। তারা চেষ্টা করছেন। এই আন্দোলনকারীদের মধ্যে দুটি ভাগ আছে। একটি বাস্তবেই বঞ্চিত। আরেকটি হচ্ছে যারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে; তারা এমনও হতে পারে আওয়ামী লীগের কর্মী, এই আন্দোলনের মধ্যে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হয়তো তাদের প্রধান উদ্দেশ্য সরকারকে বিব্রত করা।

আমি আবারও বলব, অনুগ্রহ করে ধৈর্য ধরুন। এমন কিছু করবেন না, যাতে ছাত্র-জনতার এই অসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আসা বিপ্লব বেহাত হয়ে যায়।

ডেইলি স্টার: শেষ প্রশ্ন। সাংবাদিক বা গণমাধ্যম নিপীড়নের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ যে আইনগুলো করা হয়েছিল, সেগুলো কি বাতিল করবেন না সংস্কার করবেন?

আসিফ নজরুল: এসব নিপীড়নমূলক আইনগুলো নিয়ে আপনাদের যে অবস্থান, আমার অবস্থা তারচেয়ে আলাদা নয়। আমি নিজেও এসবের জন্য ভুগেছি। আমি আপনাকে বলতে পারি, এসব আইনের ব্যবহার আর আগের মতো হবে না। আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করব এগুলো নিয়ে কী করা যায়। স্টেকহোল্ডারদের মতামতই সেখানে প্রাধান্য পাবে। তারপর দেখবো কোনটা বাতিল, কোনটা পরিবর্তনযোগ্য। চেষ্টা করব আগামী একমাসের মধ্যে ভালো কিছু সংবাদ দিতে।

Comments