আয়নাঘর

তারা আমার পরিবারের ওপরও নজর রাখতো: সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান

এম মারুফ জামান। ছবি: স্টার

ভিয়েতনামে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিলেন তার মেয়েকে আনতে।

গাড়ি চালানোর সময় তিনি লক্ষ্য করলেন, একটি মাইক্রোবাস তার গাড়ির পেছনে খুব কাছাকাছি চালানো হচ্ছে এবং ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিমানবন্দরের কাছে তার গাড়িটি আটকানো হয় এবং সাধারণ পোশাকধারী দুই ব্যক্তি মাইক্রোবাস থেকে নেমে তাকে লাঞ্ছিত করে, একপর্যায়ে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যায়।

তারা জোরপূর্বক মারুফকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়। সেখানে আরও কয়েকজন ছিলেন। মারুফের চোখ ও হাত বেঁধে মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।

তাদের চাপে পরিবারের একজনকে কল করে মারুফকে বলতে হয় যে একজন 'টেকনিশিয়ান' বাসায় যাবে, তার কাছে যেন ল্যাপটপগুলো দিয়ে দেয়।

দ্য ডেইলি স্টারকে মারুফ বলেন, 'তারা আমার ল্যাপটপ চেয়েছিল। আমি প্রথমে দিতে না চাইলেও মারধর শুরু করলে আর না দিয়ে পারিনি। পরে তারা আমার বাসা থেকে ল্যাপটপগুলো নিয়ে যায়।'

প্রায় ২০ মিনিট মাইক্রোবাসটি চলার পর থামল। কিন্তু চোখ বেঁধে রাখায় মারুফ দেখতে পাননি যে তারা কোথায় আছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন জানান, তাকে ছোট একটি নোংরা ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে একটি কাঠের বিছানা, একটি সিসিটিভি ক্যামেরা এবং চারটি ফ্যান ছিল। জায়গাটি মোটেই বাসযোগ্য ছিল না।

তিনি বলেন, 'বিভিন্ন সময়ে এই কক্ষে অনেককে আটকে রাখা হয়েছে। অনেকে দেয়ালে তাদের নাম, ঠিকানা ও তারিখ লিখে রেখেছিলেন। তিন মাস পরপর এসব দেয়াল রং করা হতো।'

আয়নাঘরে যতদিন মারুফকে আটকে রাখা হয়েছে, এর মধ্যে তাকে নয়বার বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

সাবেক এই কূটনীতিবিদ বলেন, 'তারা এমন কিছু লোকের বিষয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, যাদের আমি চিনি না। তারা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু চুক্তির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এটাও জানতে চেয়েছিল, আমি কীভাবে জানলাম যে ভারতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।'

মারুফ বলেন, 'তারা বারবার জিজ্ঞাসা করেছে যে আমি কেন আন্তর্জাতিক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সরকারবিরোধী নিবন্ধ লিখলাম।'

তুলে নেওয়ার সময় মারুফ বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি কোনো একটি সেনানিবাস এলাকায় রয়েছেন এবং সেখানে দায়িত্ব পালনকারীরা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) সদস্য।

তিনি বেশ কিছু বিষয় দেখে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছান। যেমন: 'সেনা' পানির বোতল, ওষুধ এবং সামরিক রেফারেন্সসহ কোরআনের একটি কপি।

তিনি বলেন, 'আমি এক বোতল পানি খেয়ে শেষ করার পরে তারা আমাকে সেনা নাম লেখা আরেকটি বোতল দেয়। আমাকে যে ওষুধ দিয়েছিল সেটার স্ট্রিপে লেখা ছিল ডিফেন্স মেডিসিন, বিক্রয় নিষিদ্ধ।'

'সেখানে সুপারভাইজারের কাছে একটি কুরআন চাইলে তিনি এনে দেন। সেই কুরআনে "সেকশন হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি" স্ট্যাম্প লাগানো ছিল,' বলেন তিনি।

'তারা গোপনীয়তার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বোঝাতে বড় ভাই শব্দটি ব্যবহার করতো।'

মারুফ বলেন, তিনি একবার তার কক্ষের বাইরে একজনকে জোরে বলতে শুনেছেন—'গার্ড, সাবধান'।

তিনি প্রায়ই খুব ভোরে উড়োজাহাজ ও ট্রেনের শব্দ শুনতে পেয়েছেন।

জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার মুখে আঘাত করা হয়।

'আঘাতে আমার মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং দাঁতে সমস্যা হয়ে যায়। তারা আমাকে লাঠি দিয়ে হাত ও পায়ে মারধর করে। কিন্তু কোনো প্রকার চিকিৎসা দেয়নি।'

মারুফ আরও জানতে পেরেছিলেন যে তাকে যারা তুলে নিয়ে এসেছে, তারা তার পরিবারের ওপর নজর রাখছিল।

'একদিন এক অফিসার আমাকে বললেন, আমার মেয়ে ধানমন্ডি-২৭ নম্বরের একটি রেস্তোরাঁয় আছে। আমার মেয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, সেটাও তিনি বললেন।'

বন্দি অবস্থায় ত্বকের সমস্যা, হাতের লিগামেন্টে আঘাত এবং মুখের ঘাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগেছেন মারুফ।

তার এই অগ্নিপরীক্ষার অবসান হয় ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ।

'আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। রাত ১টার দিকে একজন আমাকে ডেকে তুলে একটি জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে বলা হয়, গত ১৫ মাসের বেশি সময় সম্পর্কে কোথাও যেন কিছু না বলি।'

তার পোশাক ফেরত দিলেও ল্যাপটপ রেখে দেয়। এরপর রাত ২টার দিকে মারুফের ধানমন্ডি বাসার কাছে নিয়ে যায় এবং গাড়ি থেকে নেমে পেছনে না তাকিয়ে সোজা চলে যেতে বলে।

মারুফ ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদ থেকে অবসর নেন। ২০১৩ সালে তাকে রাষ্ট্রদূত থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

সাবেক এই কূটনীতিক গত ১৫ বছরে গুমের সব ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠনের দাবি জানান।

 

Comments

The Daily Star  | English
 Al Bakhera killings Al Bakhera killings

Killings in Chandpur: Water transport workers go on strike

Water transport workers has started an indefinite strike from midnight

5h ago