আয়নাঘর

মনে হতো কবরের ভেতরে আছি: মাইকেল চাকমা

মাইকেল চাকমা। ছবি: স্টার

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) রাজনৈতিক সংগঠক মাইকেল চাকমাকে ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী কয়েকজন। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর দিনের আলো দেখেননি তিনি।

'বন্দি থাকাকালে আমি কেবল দরজার নিচ দিয়ে বা ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিছুটা আলো দেখেছি। দীর্ঘ সময় পর গত ৭ আগস্ট আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর আবার বাইরের পৃথিবী দেখেছি', বলছিলেন মাইকেল চাকমা।

রাজধানীর শ্যামলী থেকে আটকের পর মাইকেলকে রাখা হয়েছিল একটি গোপন বন্দিশালায়—যা 'আয়নাঘর' হিসেবে পরিচিত।

গত ৭ আগস্ট মাইকেলকে যখন চট্টগ্রামের একটি সড়কে নামিয়ে দেওয়া হয়, তিনি জানতেন না যে এর দুদিন আগে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।

গত পাঁচ বছর ধরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ও মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে মাইকেলের পরিবারকে।

মাইকেল মারা গেছেন ভেবে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও সম্পন্ন করেছিল পরিবার। 'ছেলে হারানোর শোক' নিয়ে মারা গেছেন তার বাবাও।

সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক ইউপিডিএফ নেতা 'আয়নাঘর'র সেই বিভীষিকাময় সময়ের কথা বলেন।

'গত ৬ আগস্ট রাতে আমাকে চোখ বেঁধে জোর করে গাড়িতে তোলা হয়। আমি ভেবেছিলাম তারা আমাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে...।'

'২০১৯ সালে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অপহরণকারীরা আমাকে খাগড়াছড়িতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশের সময় সড়ক অবরোধের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা একটি মামলার বিষয়ে খোঁজ করছিল, যেখানে আমার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। আমি তাদের বলেছিলাম যে আমি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই', বলেন মাইকেল।

মাইকেলকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়নি। তবে, তার নির্জন কারাবাসের সময়টা এতটাই বিভীষিকাময় ছিল যে তিনি একে 'মারাত্মক মানসিক নির্যাতন' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

'আমাকে এমন অমানবিক পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছিল যে মনে হতো কবরের ভেতরে আছি। ঘরে কোনো জানালা ছিল না। কোনো ধরনের বাতাস পাইনি। কেবল চারটি দেয়াল ছিল।'

আয়নাঘরের এক সুপারভাইজারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় ৪৫ বছর বয়সী মাইকেলের। এই ঘটনার পরে তাকে আরও বেশি মানসিক নির্যাতন করা হয় এবং কিছু দিন ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হয়নি।

'তারা প্রায়ই আমাকে এমন তরকারি খেতে দিতো, যেটায় হয় খুব বেশি লবণ থাকত কিংবা অতিরিক্ত ঝাল। দীর্ঘ এক মাস আমি শুধু ভাত খেয়েই বেঁচে ছিলাম। যার কারণে আমার ওজনও অনেক কমে গেছে', বলেন মাইকেল।

এতটাই তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মাইকেলকে যে এক পর্যায়ে তিনি সেখানকার সুপারভাইজারকে অনুরোধ করেন, তাকে যেন মেরে ফেলা হয়।

'গত রমজানে যখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন চিকিৎসকরা বলেছিলেন যে আমার যত্ন নেওয়া দরকার। এরপর তারা ঠিকমতো খাবার দিতে শুরু করে।'

গোপন কারাগারটি সম্পর্কে এই ইউপিডিএফ নেতা বলেন, সেখানকার কক্ষগুলোর আয়তন ৭৭-৯৬ বর্গফুট হবে। সেখানে একটি ছোট খাট ছিল, লোহা বা কাঠের। খাটের আকার ছিল তিন বাই সাত ফুট।

ওই বন্দিশালায় আরও অনেককে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাদের একে অপরের সঙ্গে খুব কমই যোগাযোগ ছিল।

বন্দিশালায় থাকার পুরো সময় আরও দুইজনের সঙ্গে একই রুমে ছিলেন মাইকেল। তারা হলেন—রংপুরের সাইদুর ও ঢাকার কচুক্ষেতের এরশাদ। কথাবার্তা শুনে পাশের কক্ষে আরও দুজন থাকার বিষয়টি টের পান মাইকেল। কিন্তু তাদের ব্যাপারে মাইকেলের কোনো ধারণা নেই।

সাইদুরকে অন্য কোথাও স্থানান্তর করা হবে শুনে তাকে নিজের বোনের নম্বর মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলেন মাইকেল। কিন্তু পরে তিনি টের পান যে সেই ফোন নম্বরের শেষ সংখ্যাটি ভুল ছিল।

'ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় বিভিন্ন বয়সী আরও বন্দিদের দেখতে পেতাম' বলেন তিনি।

রাষ্ট্রীয় বাহিনী অপহরণ করেছে অভিযোগ তুলে জীবনের পাঁচটি বছর এভাবে আটকে রেখে নির্যাতনে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান মাইকেল।

বলেন, সুস্থ হয়ে আইনি লড়াই শুরু করবেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

The ceasefire that couldn't heal: Reflections from a survivor

I can’t forget the days in Gaza’s hospitals—the sight of dismembered children and the cries from phosphorus burns.

5h ago