আয়নাঘরের ভেতরে
বছরের পর বছর কর্তৃপক্ষ গোপন কারাগারের কথা অস্বীকার করলেও শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের অনেকে ফিরে আসছেন। তাদের মুখেই জানা যাচ্ছে সেই কারাগারের লোমহর্ষক বর্ণনা।
এই কারাগার 'আয়নাঘর' নামে পরিচিত। এখানে বন্দিদশা থেকে ফিরে আসা যারা এক সময় চুপ ছিলেন, তারা এখন নির্মমতার বর্ণনা দিচ্ছেন—যেখানে গত দেড় দশক ধরে গুম করা ব্যক্তিদের অমানবিক অবস্থায় রাখা হতো।
কাকতালীয়ভাবে বিভিন্ন বয়সী এবং ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের মানুষ কারাগার কক্ষের একই রকম বর্ণনা দিয়েছেন; চওড়া প্রাচীর, লোহার দরজা।
এই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা একত্রিত করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এর মধ্যে অনেকগুলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) পরিচালিত ছিল।
ডিজিএফআই প্রধানরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছে জবাবদিহি করেন।
এই জায়গাগুলো বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখানে বন্দিরা বাইরের কোনো আলো দেখতে পান না।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে আয়নাঘরে দিন, মাস, এমনকি বছরের পর বছর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেছেন এমন চারজনের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা তাদের একজন। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে পাঁচ বছর বন্দি ছিলেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মাত্র দুদিন পর মাইকেল মুক্তি পান।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৭ আগস্ট ভোরে যখন তারা আমাকে মুক্তি দিলো, পাঁচ বছরে প্রথমবারের মতো দিনের আলো দেখলাম।'
মাইকেল বলেন, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদল সম্পর্কে তিনি জানতেন না।
ভিয়েতনামে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। প্রায় ১৬ মাস (৪৬৭ দিন) পর ২০১৯ সালের মার্চে বাড়ি ফেরেন।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, অপহরণকারীরা কীভাবে তাকে সরকারবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিল।
তার বিবরণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে তাকে অপহরণকারীরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি কিছু শব্দ লেখা দেখেছিলেন—যেমন: পানির বোতলগুলোতে 'সেনা' (সেনাবাহিনী); ওষুধের পাতায় ডিফেন্স মেডিসিন, বিক্রয় নিষিদ্ধ; এবং বন্দি অবস্থায় তাকে যে কুরআন দেওয়া হয়েছিল, সেটি ছিল স্টেশন হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি এবং সেনাবাহিনী লাইব্রেরির।
বাকি দুজন হলেন—গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান।
২০২২ সালে আয়নাঘরে তাদের বন্দিদশা ছিল অল্প সময়ের—মাত্র সাত দিন। কিন্তু তাদের গোপন কারাবাসের সঙ্গে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শেখ হাসিনার অপছন্দের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়।
তারা দুজনই বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে।
তাদের আরও বাধ্য করা হয়, তারা যেন দাবি করেন, টাকার বিনিময়ে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোপনে একমত হওয়ার পরে নোবেল বিজয়ী তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারে শ্রমিকদের বাধ্য করেছেন।
সত্য চাপা থাকে না
আওয়ামী লীগ সরকার ধারাবাহিকভাবে নিরাপত্তা বাহিনী পরিচালিত গোপন কারাগারের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। বারবার বলা হয়েছে, সরকার ও সরকারের অর্জনকে কলঙ্কিত করতে 'গুম' শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
সরকার ২০২২ সালের ১২ মে জাতিসংঘকে লিখেছিল, 'কথিত গুমের মামলাগুলো তদন্ত করার পরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে মানুষ প্রায়শই তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে যায়। কখনো কখনো তারা পারিবারিক কলহের কারণে বা ব্যবসায়িক দায় এড়াতে আত্মগোপনের পথ বেছে নেয় এবং কেউ কেউ সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে।'
কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর আহমাদ বিন কাসেমকে মুক্তি দেওয়ার পর থেকে এই মিথ্যা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতের সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে। মীর আহমাদ বিন কাসেম ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাসেমের ছেলে। আয়নাঘরে তাদের আট বছর আটকে রাখা হয়।
আয়নাঘর থেকে মুক্তির পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে আযমী বলেন, আমাকে অন্ধকারের মধ্যে রাখা হয়েছিল, দিনের আলো দেখতে দেওয়া হয়নি। এমনকি রুমের ভেন্টিলেটরটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
এএফপিকে দেওয়া একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাতকারে ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আয়নাঘরের ভেতরে তার অগ্নিপরীক্ষা এবং আট বছরে প্রথমবারের মতো খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। মীর আহমাদ একজন আইনজীবী। তিনি তার বাবার বিরুদ্ধে হওয়া যুদ্ধাপরাধের মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে আইনি লড়াই করার সময় নিখোঁজ হন।
তিনি বলেন, ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি যে আমি একা নই। আমি আরও মানুষের কান্না শুনতে পেতাম। শুনতে পেতাম, মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং তারা চিৎকার করছেন।
আয়নাঘরের কথা প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট, যখন সুইডেনভিত্তিক একটি নিউজ পোর্টাল 'নেত্র নিউজ' তাদের প্রতিবেদনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটক রাখার জন্য গোপন কারাগারের অবস্থান প্রকাশ করে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের শতাধিক পরিবার তাদের প্রিয়জনের সম্পর্কে কোনো কিছুই না জানার অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দিনযাপন করছে। এই গুমের শিকার ব্যক্তিরা—বেশিরভাগই সরকারের সমালোচক ও বিরোধী দলের সদস্যরা—গত ১৬ বছরে নিখোঁজ হয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল, রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাদের তুলে নিয়ে গেছে।
২০২১ সালের প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ৬০০ জনেরও বেশি মানুষকে গুম করেছে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম করা ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু মানুষকে পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আদালতে হাজির করা হয়েছে কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও অন্তত ১০০ জন এখনও নিখোঁজ।
মানবাধিকার কর্মীরা নির্বাচনের আগে ও পরে, সেইসঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় গুমের ঘটনা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে অন্তত ৭০৮ জনকে গুম করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫৪টি গুমের ঘটনা ঘটেছে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে—যে সময়ে বাংলাদেশে দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৯৮ জন, ২০১৭ সালে ৯৫ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৫ সালে ৬৯ জন, ২০১৪ সালে ৪১ জন এবং ২০১৩ সালে ৫৪ জনকে গুম করা হয়েছে।
আয়নাঘরে আমন্ত্রণ
গত ৬ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের প্ল্যাটফর্ম 'মায়ের ডাক' তাদের নিখোঁজ আত্মীয়দের সম্পর্কে তথ্য জানতে ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে ডিজিএফআই অফিসের সামনে জড়ো হয়।
সেদিন হঠাৎ করেই বাড়ি ফিরে আসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর আহমাদ বিন কাসেম। পরদিন বাড়ি ফেরেন মাইকেল চাকমা।
৬ আগস্ট ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে এক বৈঠকে মানবাধিকারকর্মী ও জাতিসংঘের একজন প্রতিনিধিসহ ছয় সদস্যের একটি দল সেই গোপন আটকখানায় প্রবেশাধিকারের দাবি জানায়। দলটিকে ৭ আগস্ট ডিজিএফআই সদর দপ্তরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
সেখান থেকে বের হয়ে মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক কয়েকটি ভুক্তভোগী পরিবারকে বলেন, তারা আমাদেরকে আটকখানাগুলো দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ডিজিএফআই বলেছে যে ঢাকায় তাদের কাছে কেউ আটক নেই। তারা আরও বলেছে যে সারা দেশে তাদের ২৩টি কার্যালয়ের অন্য কোথাও কাউকে গুম করে রাখা আছে কি না তা সবাইকে দেখাতে একটি যৌথ কমিশন গঠন করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছে এ বিষয়ে জানতে কল ও টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরও (আইএসপিআর) এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছে, তারা ডিজিএফআই সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করে না।
গত ১৩ আগস্ট মায়ের ডাকের সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রফেসর ড. ইউনূস পরিবারগুলোর কথা শোনার পর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
গত রোববার ডিজিএফআইয়ের কাছে নিখোঁজ ১৫৮ জনের একটি তালিকা পাঠিয়েছে মায়ের ডাক।
সংগঠনটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা আফরোজা ইসলাম আঁখি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের আশ্বস্ত করেছে যে এই বিষয়টির সমাধান তারা করবে।
সারা দেশে অসংখ্য গোপন কারাগারের তথ্য জানতে চান উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আমাদের যেসব দাবি ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল গুমের ঘটনায় তার ভূমিকা তদন্ত করা। আমরা একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবিও জানিয়েছি, যেটিতে সরকার তারা সম্মত হয়েছে।'
মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন দীর্ঘদিন ধরে গুম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। তিনি জানান, কথিত রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নেওয়ার পরেও অনেকের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, 'এখনই তাদের মুক্তি দাবি করার সময় এবং রাষ্ট্রের উচিৎ তাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেওয়া।'
Comments