কোরিয়ান ইপিজেডে সবুজে মোড়া আধুনিক স্থাপনা

কেইপিজেড
চট্টগ্রামে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড)। ছবি: কেইপিজেড

বাদল দিনের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। গন্তব্য বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পরিবেশবান্ধব শিল্পাঞ্চল কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড)।

শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূবে আনোয়ারা উপজেলায় স্বয়ংক্রিয় প্রবেশপথ দিয়ে কেইপিজেডে ঢুকি। প্রধান রাস্তার পাশে সুপরিকল্পিত বহুতল ভবন।

ডান দিকে কারখানার গুদাম। বিশ্বখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানের অত্যাধুনিক কারখানা চোখে পড়ল। বামে নির্মাণাধীন পলিয়েস্টার সুতার কারখানা। এর সুবিশাল প্রাঙ্গণ চোখ জুড়িয়ে দেয়।

এরপর ধীরে ধীরে পার হই প্যাডিং, প্রিন্টিং ও তৈরি পোশাকের কারখানা।

শুরুতে সবাই চুপচাপ। চোখজুড়ানো সবুজের সমারোহে দেখা মেলে নিরাপত্তাকর্মী, বড় বড় কাঠামো বা নির্মাণাধীন কারখানা।

সবুজের ভেতর দিয়ে যতই এগোতে থাকি প্রশান্তিতে মন ততই ভরে যায়। পাহাড়ি পথের পাশে নানান জাতের গাছের ঝোপঝাড় ও ছোট ছোট হ্রদ বা জলাশয়।

সৌভাগ্যবান হলে কেউ এক ঝলকে দেখতে পাবেন হ্রদের উলটো পাশে বন্য হাতির নীরব চলাফেরা। এখানকার ঘন সবুজ বনের নির্জনতা ও খোলা প্রান্তর শহুরে আবহের বাইরে ভিন্ন অনুভূতি জাগায়।

কেইপিজেডের আয়তন দুই হাজার ৪৯২ একর। এর ৫২ শতাংশে গাছ, জলাশয় ও খোলা জায়গা।

কেইপিজেড
কেইপিজেডে বর্তমানে ৪৮টি কারখানা আছে। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

এই অনন্য এলাকায় দেশের একমাত্র বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। এখানে মানুষ, মেশিন, গাছ ও বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগৎ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে।

ছোট ছোট এলাকায় কারখানা। হ্রদ-জলাশয়ের সংখ্যা ৩৩। আছে ১৩৭ প্রজাতির পাখি ও ৮৭ প্রজাতির বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী।

শিল্পোন্নত দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের সহায়ক প্রতিষ্ঠান কেইপিজেডে বর্তমানে ৪৮টি কারখানা আছে। এগুলোর মালিক ইয়ংওয়ান।

রপ্তানির জন্য বাংলাদেশে পোশাক কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে ইয়াংওয়ান প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান।

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রিমিয়াম জ্যাকেট ও সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি ট্রাউজার, স্পোর্টস জুতা, চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ, ব্যাকপ্যাক ও ট্রাভেল ব্যাগ রপ্তানিতে কেইপিজেডের কারখানাগুলোর বেশ খ্যাতি আছে।

এখানকার কারখানাগুলো প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে।

বিদেশি কর্মী ও ক্রেতাদের থাকার ডরমিটরিতে বসে কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) করপোরেশন (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য এখান থেকে বার্ষিক রপ্তানি এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। আশা করছি, সব কারখানা পুরোদমে চালু হলে তা অর্জন করা সম্ভব।'

প্রকল্পটি শুরুর পর থেকে এখানে সরাসরি কাজ করছেন ৩১ হাজার মানুষ। কর্মীদের বেশিরভাগ নারী। এই এলাকার বাইরে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে।

২০১১ সালে বাংলাদেশ বেসরকারি ইপিজেড আইনের আওতায় বেসরকারি শিল্পাঞ্চলের কাজ শুরু হয়।

কেইপিজেড
কেইপিজেডের কারখানাগুলো প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

মো. শাহজাহান আরও বলেন, 'এলাকাটি একসময় টিলাময় ছিল। বেশিরভাগই খাস জমি। আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করে এই এলাকার উন্নয়ন করেছি।'

কেইপিজেডের কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তারা এখানে ২৭ লাখ গাছ লাগিয়েছেন। এর মধ্যে ৪০০টিরও বেশি প্রজাতির গাছ আছে।

কেইপিজেডের ভেতরে রাস্তা আছে ৪০ কিলোমিটার। কারখানার কাঁচামাল ও তৈরি পণ্য পরিবহনের সুবিধায় ছয় কিলোমিটার প্রধান সড়ক তৈরি করা হয়েছে।

১৯৮০ সালে রপ্তানি পোশাক তৈরি শুরুর সিদ্ধান্তের পর কেইপিজেড ইয়াংওয়ানের তৃতীয় বড় প্রকল্প।

ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক কিহাক সাং চট্টগ্রামে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর স্থানীয় এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পোশাক তৈরি শুরু করেন। তখন বন্দর নগরীতে ভাড়া করা কারখানায় পোশাক উৎপাদন শুরু হয়।

১৯৮৭ সালে ইয়ংওয়ান চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে কারখানা করে। ১৯৯৩ সালে তাদের প্রথম বিনিয়োগ হয় ঢাকা ইপিজেডে।

বাংলাদেশে ইয়ংওয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ শাহিনুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসব কারখানায় কৃত্রিম সুতা দিয়ে পোশাক তৈরি হচ্ছে।'

পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে তারা জুতা তৈরি শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে কারখানা সম্প্রসারণে জোর দেন।

সংশ্লিষ্টরা ডেইলি স্টারকে জানান, দুই হাজার ৪৯২ একর জমির মধ্যে ৫২ শতাংশ বা এক হাজার ২৯৬ একর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশগত ছাড়পত্র নিয়ে সবুজায়ন করা হয়।

বাকি ৪৮ শতাংশ বা এক হাজার ১৯৬ একর ব্যবহার করা হয় রাস্তা, ইউটিলিটি, অবকাঠামো ও কারখানার জন্য। এর মধ্যে ৩০ শতাংশে রাস্তা, ইউটিলিটি ও অবকাঠামো। বাকি ৮১২ একরে কারখানা।

কেইপিজেড
কেইপিজেডে দেশের সবচেয়ে বড় ৪০ মেগাওয়াট সৌরশক্তির প্ল্যান্ট করেছে ইয়ংওয়ান। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

এই জমির উল্লেখযোগ্য অংশ কারখানার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭৩২ একর জমি কারখানার জন্য তৈরি রাখা হয়েছে।

বর্তমানে ৬০০ একর জমিতে কারখানা ও আনুষঙ্গিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। অবশিষ্ট জমিতে কাজ চলছে।

এখানে সফটওয়্যার ও আইটিখাতের জন্য ১৬টি ২৪ তলা ভবন তৈরির পরিকল্পনা করছে ইয়াংওয়ান।

মো. শাহজাহান জানান, আইটি ব্লকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাজের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইটির সঙ্গে জড়িত ২০ হাজার মানুষের কাজের সুযোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটি এই শিল্পাঞ্চলটিকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলছে।

তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও জুতা তৈরির পাশাপাশি ইয়াংওয়ান বিশ্ববাজারে তাদের পণ্যের জন্য ১০টি ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ডিডিসি) স্থাপন করেছে। স্থানীয় শীর্ষ স্থপতিদের ডিজাইন করা এসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে।

মো. শাহজাহান আরও বলেন, 'আমরা কেইপিজেডে দূষণকারী শিল্পকারখানার অনুমতি দিই না। কেউ এখানে বস্ত্র ও ডাইং কারখানা করতে চাইলে অবশ্যই বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) করতে হবে।'

কেইপিজেড পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দেয়। পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি উত্পাদন ও ক্ষতিকর জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে ছাদে সৌরশক্তির ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

কেইপিজেডে ৪০ মেগাওয়াট সৌরশক্তির প্ল্যান্ট করেছে ইয়ংওয়ান। এটি দেশে সবচেয়ে বড়।

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পাঁচ হাজার ৪০০ নারী শ্রমিকের থাকার জন্য ডরমিটরি, কর্মজীবী বাবা-মায়েদের জন্য মেডিকেল সেন্টার ও ডে কেয়ার সুবিধা দিচ্ছে।

মাত্র দুই টাকায় শ্রমিকদের দুপুরের খাবার আসে একটি স্বয়ংক্রিয় রান্নাঘর থেকে। সব কারখানার শ্রমিকরা যাতে এক সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে পারেন তার জন্য সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ছুটি থাকে।

কেইপিজেড
রপ্তানির জন্য বাংলাদেশে পোশাক কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে ইয়াংওয়ান প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

এক কারখানা থেকে আরেক কারখানায় যাওয়ার পর দুপুর দেড়টার দিকে আমরা ক্যান্টিনে যাই। জমাট পরিবেশ, শ্রমিকদের আড্ডা ও খাবার টেবিলকে ঘিরে তাদের প্রাণচাঞ্চল্য দেখতে পাই।

সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিকদের নীল টোকেন দেখিয়ে খাবার নিতে দেখি।

রান্নাঘরে ঢুকে ঢাকার ইয়ংওয়ান করপোরেশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ফেরদৌস আল কাওসার বলেন, 'আমাদের পুষ্টিবিদ আছেন। তিনি শ্রমিকদের খাবারের মান তদারকি করেন।'

কাছাকাছি আছে চিকিৎসা সুবিধাও। প্রায় এক ডজন শ্রমিককে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে দেখি।

কেইপিজেডের ন্যায্য মূল্যের দোকানটিও জমজমাট দেখা গেল।

মো. শাহজাহান আরও জানান, এখানকার বেশিরভাগ শ্রমিকের বাড়ি কেইপিজেডের কাছাকাছি। কারখানায় যোগ দেওয়ার পর প্রথমবারের মতো তারা আয় শুরু করেছেন।

'এখানে কাজের সুযোগ স্থানীয় নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা দিয়েছে' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কর্মসংস্থানের ফলে এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। মানুষের হাতে টাকা থাকায় স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। আশেপাশের গ্রামগুলোয় শ্রমিকদের পরিবহনের জন্য প্রতিদিন ৬০০টিরও বেশি যানবাহন চলাচল করে।

কেইপিজেডে বিনিয়োগের প্রণোদনা সম্পর্কে তিনি জানান, বিনিয়োগকারীরা এখানে সরকার নির্ধারিত সব আর্থিক ও অরাজস্ব সুবিধা পেয়ে থাকেন।

মো. শাহজাহান আরও বলেন, 'ইয়াংওয়ানের কর্মীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করছেন চেয়ারম্যান কিহাক সাং।'

শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সাধারণ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ ও স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট নিয়ে আন্তর্জাতিকমানের মেডিকেল কমপ্লেক্স তৈরির পরিকল্পনা তার আছে।

তিনি কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট ও সাধারণ শিক্ষা সুবিধা দেওয়ার চিন্তা করছেন।

কিহাক সাং আশেপাশের গ্রামের মানুষের সুস্বাস্থ্যের ওপরও জোর দেন। এ জন্য তিনি ব্যাপক পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতামূলক প্রচারণা করছেন।

সন্ধ্যায় আমরা যখন ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন দেখি সকালের নির্জন প্রধান সড়কটি শ্রমিকদের ভিড়ে ঢেকে গেছে। তাদেরকে বাড়ি যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

আমরা যখন কেইপিজেডের মূল ফটকে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা।

দূরে নিরাপত্তাকর্মীদের হুইসেলের শব্দ শোনা যায়। শ্রমিকদের সুশৃঙ্খলভাবে বাস ও তিন চাকার বৈদ্যুতিক গাড়িতে উঠতে সহায়তা করতে হুইসেল দেওয়া হচ্ছিল।

Comments

The Daily Star  | English

Not for kidney patient, they tried to rob bank for iPhones

Police say three robbers fabricated a story claiming that the robbery was to save a kidney patient

1h ago