উল্টো স্রোতে সাঁতরে বাংলাদেশের ক্রিকেট আঙিনায় অনিক 

Anik Deb Barman
পেসার অনিক দেব বর্মণ

বিসিবির একাডেমি মাঠে দূর থেকেই আলাদা করে নজর কাড়লেন লিকলিকে এক তরুণ। উচ্চতা ৬ ফিট ৩ ইঞ্চি। তবে উচ্চতার জন্য নয়, চেহারার গড়নের কারণেই বাকিদের থেকে তিনি আলাদা। অনিক দেব বর্মণ আসলেই বাকিদের থেকে আলাদা। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর কারো বাংলাদেশের পুরুষদের ক্রিকেটের মূল স্রোতে এর আগে আসার নজির নেই।

হবিগঞ্জের বাহুবলের কালিগুচিয়া গ্রামে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির বাস। অনিক সেখানকারই ছেলে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় ত্রিপুরাদের নিবাস। এই জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ফুটবলের চল থাকলেও ক্রিকেটের সংস্কৃতি একেবারেই নেই।

Anik Deb Barman
বাকিদের থেকে সহজেই আলাদা করা যায় অনিক দেব বর্মণকে

অনিক বলা চলে উল্টো স্রোতে সাঁতার কেটে পৌঁছে গেছেন বড় মঞ্চে। ২০২৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ সামনে রেখে যুবদল তৈরি করতে ৩০ জনকে নিয়ে চলছে প্রাথমিক ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে জায়গা করে নিয়েছেন অনিক। দীর্ঘদেহী অনিক তার পেস, স্যুয়িং দিয়ে মূল দলেও আসতে যাচ্ছেন বলে অনেকটা নিশ্চিত। কোচ নাজমুল হোসেন তো বলেই দিলেন বাকিদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে অনিক।

বাহুবলের ছেলে হলেও অনিকদের পরিবারের বর্তমান নিবাস শ্রীমঙ্গলে। খেলা অবশ্য শুরু করেছিলেন গ্রামেই। তাদের গ্রামে ফুটবলের জন্য মাঠ থাকলেও ক্রিকেট খেলার কোন ব্যবস্থা ছিলো না, তিনি ছোট জায়গাতেই হাত ভেঙে বল করতেন। তা দেখেই এলাকার বড় ভাইয়ের নজরে পড়েন।

অনিক শনিবার মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের জানান নিজের উঠে আসার গল্প, 'আমাদের বাসায় সাদা-কালো টিভি ছিল। ছোটবেলায় আমি সেখানে অনেক খেলা দেখতাম। বেশিরভাগ ভারতের খেলা দেখতাম। তখন আমি প্রায় সব ক্রিকেটারের নাম জানতাম। তখনই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার শুরু। বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম। ওখান থেকে আস্তে আস্তে এখানে আসা।'

একে তো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিকেটে চল নেই। তারমধ্যে পড়াশোনার ক্ষতি করে খেলাধুলা করে অনিশ্চিত গন্তব্যে হাঁটার ঝুঁকি। পরিবারের আপত্তি তাই ছিলো প্রবল। কিন্তু অনিকের ক্রিকেট-প্রেমে এক সময় হার মানেন তার বাবা,  'আমার পরিবার তো শুরুতে কেউ সমর্থন দিত না। তখন আমি পালিয়ে খেলতাম। আমাকে মানুষ বাসা থেকে এসে নিয়ে যেত (খেলতে)। বাবা মানা করতেন। খেলে কী হবে, কী করব, এসব বলতেন। তবু আমি পালিয়ে খেলতাম। মারও খেয়েছি অনেক।'

Anik Deb Barman
মিরপুরে অনিক দেব বর্মণ।

এখন যে স্রোতে এসে পড়েছেন। তাতে নিজেকে ধরে রাখতে পারলে, শানিত করতে পারলে উজ্জ্বল সম্ভাবনা বড় কিছু করার। অনিকও তাই স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশ দলের, 'আমার স্বপ্ন, আমি এক দিন বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলব। এটাই স্বপ্ন। এখন যে মঞ্চটা পেয়েছি, মনে হচ্ছে সামনে এগোতে পারি। কোচরা বলেছেন, "তুমি ভালো বোলিং করো। সামনে আরও ভালো হবে।"'

হবিগঞ্জেরই ছেলে বাংলাদেশের প্রাক্তন পেসার ও বর্তমান বয়সভিত্তিক কোচ নাজমুল অনিকের খোঁজ পান স্থানীয় মাধ্যমে। প্রথমে ভিডিওতে বোলিং দেখেই তাকে জেলা দলে নিয়ে নেন। অনিকও নিজেকে দ্রুত প্রমাণ করে বিভাগীয় বয়সভিত্তিক দলেও ঠাঁই করে এখন বাংলাদেশের যুব দলের কিনারে,  'আমি ওকে জেলা দলে নিতে বললাম। এরপর বাকি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ও নিজেই চলে এসেছে। নিজেই পারফর্ম করেছে। বাকি যারা ছিল, তাদের চেয়ে বেশি প্রতিভাবান ও। যুব ক্রিকেট লিগে ওর পারফরম্যান্স ভালো ছিল। আর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে খেলাগুলোতে কিন্তু পারফরম্যান্সের চেয়ে আমরা প্রতিভা বা কোন দিকে যাবে, সেগুলো আমরা বেশি মূল্যায়ন করি। এগুলো চিন্তা করে, আমার মনে হয়েছে ও সম্ভাবনাময়।'

যুব ওয়ানডে লিগে অনিকের পারফরম্যান্স ছিল নজরকাড়া। বাকি পেসারদের থেকে ডানহাতি এই পেসার ছিলেন অনেকটা এগিয়ে। তাকে দ্রুত উঠার সিঁড়ি দেখিয়ে দিতে সমস্যা হয়নি নাজমুলদের, 'আমাদের মনে হয়েছে, আমরা যদি ওকে নার্সিং করি, তাহলে অনেক দূর যেতে পারে। এই চিন্তা করেই ওকে নেওয়া। এছাড়া জেলা পর্যায়ে আমরা দেখেছি, প্রত্যেকটা ম্যাচে ওর আশেপাশে কেউ নেই। নিজেই তাই অটোমেটিক চলে এসেছে এই পর্যায়ে।'

অনিকের মূল শক্তি ইনস্যুয়িং। সেই সঙ্গে বেশ ভালো গতিও আছে। উচ্চতার কারণে আছে বাড়তি বাউন্স। গতি, স্যুয়িং আগামীতে আরও বাড়বে বলে বিশ্বাস নাজমুলের,  'আসলে আমার নিজেরও একটা ভুল ধারণা ছিল যে, আদিবাসীরা এত লম্বা হয় না। কিন্তু অনিক ৬ ফুটের বেশি। ওর যে বয়স, আমার মনে হচ্ছে, আরও লম্বা হবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর পোক্ত হবে, গতি আরও বাড়বে। পেশাদার ক্রিকেট এখনও বোঝেনি। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে আসার পরে বুঝতে শিখেছে। আমি মনে করি, গতিটা বাড়া সম্ভব। সঙ্গে সুইং আছে।'

'শুধু উচ্চতা নয়, ওর রান-আপ থেকে শুরু করে সব কিছুই আমাদের ভালো লেগেছে। অন্য যে বোলার দেখেছি তাদের চেয়ে ওর গতি বলেন, অ্যাকুরেসি বলেন, রান-আপ বা সব কিছু মিলিয়ে আমরা নির্বাচক প্যানেলে যারা ছিলাম, তাদের মনে হয়েছে, বাকিদের চেয়ে অনিক ভালো। আমি মনে করি, ওর ভবিষ্যৎ ভালো।'

বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষার্থী অনিক। তবে এখন বাবা আর চিন্তা করছেন না। অনিক ক্রিকেট খেলে বড় কিছু করতে পারবেন বলে পরিবারে বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। যে নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবা আগে বাধা দিতেন, তিনিই কিনে দিয়েছেন খেলার বুট। অনিক সেই সাহস মেখেই ছুটতে চান।

Comments

The Daily Star  | English

Trump launches trade war with tariffs on Mexico, Canada and China

President Donald Trump announced broad tariffs Saturday on major US trading partners Canada, Mexico and China, claiming a "major threat" from illegal immigration and drugs -- a move that sparked promises of retaliation.

2h ago