জনতা ব্যাংককে বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো

শেখ হাসিনা, জনতা ব্যাংক, সালমান এফ রহমান, ঋণ খেলাপি, বাংলাদেশ ব্যাংক,

একজন গ্রাহক বা কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপকে ঋণ দিতে এক্সপোজার সীমা নিয়ে একটি বিধান আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। একক ঋণগ্রহীতার এই এক্সপোজার সীমার একটি উদ্দেশ্যও আছে। কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য? এই প্রশ্নের উত্তর হলো- কোনো ব্যাংকের ভবিষ্যৎ যেন ঝুঁকিতে না পড়ে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা।

কিন্তু একটি নথিতে দেখা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বাধীন দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক এই নিয়ম প্রয়োগ করেনি।

ফলে, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা অনিশ্চিতয়তার মধ্যে আছে।

র‌াষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৪৯ শতাংশ মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ বেক্সিমকো গ্রুপের। প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ী গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে গতকাল দশ দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর আগে গত পরশু তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জুন শেষে জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের প্রায় ৯৫০ শতাংশ।

বিধি অনুযায়ী, একজন বা একক ঋণগ্রহীতাকে ব্যাংকগুলো তাদের পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারবে না। সেখানে জুন শেষে জনতার পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।

অথচ নথিতে দেখা যায়, জনতা থেকে নেওয়া বেক্সিমকোর ঋণের ৭২ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

আরও জানা গেছে, জনতার বিতরণ করা ৯৮ হাজার কোটি টাকার ঋণের ২৫ দশমিক ৫১ শতাংশ বেক্সিমকোর মালিকাধীনা ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এই ৩০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টি একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা লঙ্ঘন করেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, ২০১৮ সাল থেকে ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সালমান এফ রহমান ব্যাংকিং বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে জনতা বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন।

এছাড়া গত তিন বছরে জনতা ব্যাংকের ঋণ বেড়েছে দ্রুত গতিতে।

২০১৫ সালে জনতার কাছে বেক্সিমকো ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। সর্বশেষ এ বছরের জুন শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।

নথিতে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত বেক্সিমকো নয়টি নতুন কোম্পানি চালু করেছে। এর মধ্যে ২০২২ সাল মাত্র এক মাসে আটটি নতুন কোম্পানি তৈরি করে ওই সব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, শেখ হাসিনা প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় ঋণের বিশেষ অনুমোদন পাইয়ে নিয়েছেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জনতার একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা লঙ্ঘন করলেও গত বছরের ১ আগস্ট বেক্সিমকোকে ৪৭৯ কোটি টাকা ঋণ দিতে অনাপত্তিপত্র দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংক তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বেক্সিমকোকে এই ছাড় দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'শীর্ষ পর্যায়ের কাছ থেকে এ ধরনের ছাড় দেওয়া এ খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা।'

সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ঋণ আদায়ের উদ্দেশ্যে এই ছাড় দেওয়া হয়েছে।

তখন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরই ঋণ দেওয়া হয়েছে।

জনতার কর্মকর্তারা জানান, সালমান এফ রহমান সবসময় ঋণ পুনঃতফসিল করতেন এবং বেক্সিমকোকে খেলাপিদের তালিকাভুক্ত না করতে তার রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করতেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, পিপিই, সিরামিক, রিয়েল এস্টেট, কনস্ট্রাকশন, ট্রেডিং, মেরিন ফুড, আইসিটি, মিডিয়া, ডিটিএইচ, ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস ও এনার্জি খাতে আগ্রহী এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি তাদের ঋণের একটি বড় অংশ ২০২২ সালের জুনে এবং বাকিটা গত বছরের জুনে পুনঃতফসিল করেছে।

এসব ঋণের বড় অংশ খেলাপি হওয়ায় গত ৩০ জুলাই ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় নতুন করে পুনঃতফসিল প্যাকেজ উপস্থাপন করা হয়।

নথিতে দেখা যায়, সেই প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনতার এক কর্মকর্তা বলেন, 'এ কারণে বেক্সিমকোর প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ মন্দ হয়ে গেছে।'

যে ঋণ খোয়া গেছে তার মধ্যে ৫ হাজার ৩০ কোটি টাকা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ)। ইডিএফ মূলত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অর্থায়ন করা একটি তহবিল।

বেক্সিমকোতে জনতার ঝুঁকিপূর্ণ এক্সপোজারের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার বলেন, কিছু ঋণ শাখা পর্যায় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল বা বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়নি।

নথিতে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকে ৬০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এটি হলো রাজধানীর মতিঝিলের দিলকুশা শাখা।

তিনি গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ কারণে একটি গ্রুপ বিপুল পরিমাণ ঋণ নিতে পেরেছে। তবে আমি এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর এ ধরনের অপব্যবহার কমে এসেছে। আমি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার আর অবনতি হতে দিইনি।'

গত বছরের ১৩ এপ্রিল তিন বছরের চুক্তিতে এমডি হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুল জব্বার।

এক সময় বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য ব্যাংক ছিল জনতা। কিন্তু অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্টের সঙ্গে জড়িত একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়।

জনতার অন্য বড় ঋণ ঋণগ্রহীতার মধ্যে আছে- এস আলম গ্রুপ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, ওরিয়ন গ্রুপ ও রতনপুর গ্রুপ।

২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন শেষে জনতার মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।

তবে, জনতার ঋণ নিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য জানতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।

(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল। ইংরেজি প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন  www.thedailystar.net/business/economy/banks/news/beximco-leaves-janata-bank-poor-health-3677526)

Comments

The Daily Star  | English