ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎ প্রকল্প বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অদ্ভুত প্রচেষ্টা’

ছয় বছর ধরে স্থগিত এই বিদুৎকেন্দ্রে ঋণ দিতে নীতি শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফলে ওরিয়নের এই প্রকল্পে ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় অগ্রণী, জনতা ও রুপালী ব্যাংক।
ওরিয়ন, বাংলাদেশ ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রুপালী ব্যাংক,

ওরিয়ন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাঁচাতে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাদের সীমা অতিক্রম করে ঋণ অনুমোদন করেছে।

ছয় বছর ধরে স্থগিত এই বিদুৎকেন্দ্রে ঋণ দিতে নীতি শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফলে ওরিয়নের এই প্রকল্পে ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় অগ্রণী, জনতা ও রুপালী ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর কাছে ওরিয়ন গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির ৬ হাজার ২৪৪ কোটি টাকার ঋণ থাকা স্বত্তেও নতুন করে বিপুল পরিমাণ এই ঋণের অনুমোদন করা হয়, তবে এই ঋণ এখনও বিতরণ করা হয়নি। সম্প্রতি  ওরিয়ন গ্রুপ প্রকল্পটিকে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ওরিয়ন গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোট ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে ৬১৬ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩৫৭ কোটি এবং এবি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকার ঋণ আছে।

ব্যাংক ও ওরিয়নের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশি বিনিয়োগ পেতে ব্যর্থ হওয়ার পর ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা-২ লিমিটেডের (ওপিডিএল-২) আওতায় কক্সবাজারের মহেশখালীতে এই প্রকল্পের জন্য গত বছর অনুমোদিত সিন্ডিকেটেড ঋণের জন্য অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের দিকে তাকিয়েছিল ব্যবসায়ী গ্রুপটি।

এর আগে, ২০২২ সালের নভেম্বরে ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১-এর ২৬-খ (১) ধারা শিথিল করার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার।

ওই ধারাতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক একক ঋণগ্রহীতাকে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারবে না।

কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানিটিকে সুবিধা দিতে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য এ নিয়ম শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ওপিডিএল-২ ঋণের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দিয়েছে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, কোম্পানির ঋণ ঝুঁকি নিরূপণের পর গ্রাহক ঋণ পাবেন কিনা তা নির্ধারণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নয়।

তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু আইনি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে এবং আইনে সুযোগ থাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওই ব্যাংকগুলোকে এনওসি দিয়েছে।'

তার ভাষ্য, 'বিদ্যুৎ উৎপাদনে গতি আনতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।'

তবে, আওয়ামী সরকারের পতন ও আব্দুর রউফ তালুকদারের পদত্যাগের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদানের আগে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম মেনে নেওয়া যায় না।'

তিনি আরও বলেছিলেন, 'আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দরকার নেই, আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি দরকার।'

রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদন ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের জন্য 'ভালো' খবর নয় বলেও মন্তব্য করেছিলেন আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, 'রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে কোনো জবাবদিহিতা ও সুশাসন নেই। এজন্য তারা (কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো) এসব ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে পেরেছে।'

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর তদারকির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনটি ব্যাংক এমন এক সময়ে ঋণ অনুমোদন দিয়েছে, যখন তাদের ঋণের বড় একটি অংশ ইতোমধ্যে কিছু বড় ঋণগ্রহীতার দখলে ছিল, যা 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ'।

তিনি মনে করেন, একটি ব্যাংকের ঝুঁকি তখনই বেড়ে যায়, যখন একক গ্রাহক ঋণের বড় অংশ পান, কখনো কখনো গ্রাহকের মূলধনের চেয়েও বেশি।

এখানে উদাহরণ হিসেবে জনতা ব্যাংকের কথা বলা যায়। কারণ ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৫৭ শতাংশই অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, রতনপুর, এস আলম গ্রুপসহ সাতটি বড় কোম্পানির দখলে।

ঝুঁকিতে থাকা  জনতা ব্যাংক ওরিয়ন পাওয়ারের জন্য ৫ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে, যা ব্যাংকটির ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের ২১৯ শতাংশ। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের শিথিল করা ২৫ শতাংশ সীমার চেয়ে অনেক বেশি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ওরিয়ন গ্রুপ ইতোমধ্যে জনতার অন্যতম শীর্ষ ঋণগ্রহীতা ছিল।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ জনতার ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৭ সালে ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা।

অ্যাননটেক্স, বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের কারণে ব্যাংকটি তীব্র সংকটে পড়েছে। ফলে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

গত বছরের এপ্রিলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেওয়া আবদুল জব্বার সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

জনতা ব্যাংক এখনো ঋণ বিতরণ করেনি বলে জানান আবদুল জব্বার।

তিনি বলেন, 'আমি ব্যাংকটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার চেষ্টা করছি। আমি ব্যাংকটিকে আরও অবনতি থেকে রক্ষা করতে চাই।'

অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংক ওপিডিএল-২ এর জন্য ২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে, যা ব্যাংকটির ২ হাজার ৭২ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে ১৩৮ শতাংশ বেশি। ওরিয়ন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির কাছে ২ হাজার ২৫০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা দায় থাকা সত্ত্বেও নতুন ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রূপালী ব্যাংক গত বছর কোম্পানিটির জন্য ২ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা ঋণের অনুমোদন দিয়েছে, যা ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৪৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার চেয়ে ৫৬৯ শতাংশ বেশি। এদিকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ওরিয়ন গ্রুপের সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোর কাছে রূপালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অগ্রণীর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৮ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি খেলাপি ছিল ১৪ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. মুরশেদুল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সম্প্রতি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করা জায়েদ বখত বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে 'যথাযথ যাচাই-বাছাই করে' অনেক আগেই এই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকার ওরিয়নের প্ল্যান্ট অনুমোদন করায় এবং সেখান থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করায় অগ্রণী ব্যাংক এই ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ২১ শতাংশ। গত বছর ব্যাংকটির ২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি ছিল।

এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ওরিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'কোনো ধরনের অযাচিত প্রভাব ছাড়াই কয়লা প্রকল্পের আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে' অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক থেকে সিন্ডিকেটেড ঋণের অনুমোদন পেয়েছেন তারা।

তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান' প্রকৌশল পরামর্শদাতাদের সহযোগিতায় জমি ক্রয়, ভূমি উন্নয়ন এবং মৌলিক ও বিশদ প্রকৌশলসহ ওরিয়নের ইক্যুইটি থেকে কয়লা প্রকল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও টেকসই জ্বালানি জন্য ব্যবসায়ী গ্রুপটি সৌর প্রকল্পের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তিনি।

সালমান ওবায়দুল করিম বলেন, 'আগের সরকারের আমলে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত 'স্বল্পমেয়াদী লাভের চেয়ে দেশের কল্যাণের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিশ্রুতির' প্রতিফলন।

সালমান ওবায়দুল করিম জানান, তারা কয়লা প্রকল্পের জন্য অনুমোদিত ঋণ বাতিল ও সৌর প্রকল্পের জন্য নতুন ঋণ অনুমোদনের জন্য ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করেছিলেন। রূপালী ব্যাংক গত এপ্রিলে ঋণের অংশ বাতিল করে পুরো সিন্ডিকেট ঋণ বাতিল করেছে।

সেক্টর সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, বিতরণ করা হলে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ প্রকল্প ঋণের মেয়াদ হবে ১৫ বছর এবং প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।

ওরিয়ন প্রাথমিকভাবে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরে ২০২৬ সাল থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহের আশায় প্রকল্পটি কক্সবাজারের মহেশখালীতে স্থানান্তরিত করে।

সালমান ওবায়দুল করিম বলেন, কয়লা প্রকল্পে ভূমি উন্নয়নের জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ করা অর্থ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জমিতে সৌর প্রকল্পে পুনরায় বরাদ্দ করা হয়েছে।

'কোম্পানিটি মুন্সীগঞ্জের জমিতে একটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য নতুন ঋণের জন্যও আবেদন করেছে, যেখানে প্রাথমিকভাবে কয়লা প্রকল্পটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ঋণ বাতিল প্রমাণ করে যে, কোনো বিশেষ অনুগ্রহ চাওয়া বা গ্রহণ করা হয়নি।'

Comments