আইএমএফের ঋণের পরের কিস্তি পেতে মানতে হবে নতুন ৩৩ শর্ত

আইএমএফ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় পরবর্তী দুটি কিস্তি পেতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে বাংলাদেশকে ৩৩টি নতুন শর্ত পূরণ করতে হবে।

গত সোমবার আইএমএফের তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে এই শর্তগুলোর বিষয়েও জানানো হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি হার, নিম্ন রাজস্ব আয় এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব-এই চার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার লক্ষ্যে নতুন শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভাকে লেখা এক চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন: 'বৈশ্বিক চাপের কারণে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা কঠিন করে তুলেছে।'

এই কঠিন পরিস্থিতি বিবেচনায়, আমরা আমাদের প্রচেষ্টা বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, জানান অর্থমন্ত্রী।

উন্নয়ন অব্যাহত রাখা এবং সামাজিক ব্যয় বাড়ানো, রাজস্ব আয় বাড়ানো, মুদ্রানীতি কাঠামোকে আধুনিকীকরণ এবং বিনিময় হারের নমনীয়তা আরও বাড়াতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, সরকার আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমাতে এবং পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আরও ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে কাজ করবে।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে দুই ধরনের শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি কর্মদক্ষতার (পারফরম্যান্স) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং বাকিগুলো কাঠামোগত শর্ত।

সাতটি শর্তের মধ্যে, বাংলাদেশকে আগামী জুনের মধ্যে নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ (এনআইআর) বাড়িয়ে ১৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার করতে হবে। এই বছরের জুনের জন্য সংশোধিত লক্ষ্য ছিল ১৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক বাজেট ঘাটতি নির্ধারিত ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, যা ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ হলো, আগামী অর্থবছরে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও বেশি কৃছ্রতা অবলম্বন করতে হবে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর-রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এর অর্থ, সরকারকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে ২১ শতাংশের বেশি। যদিও গত কয়েক বছর ধরে গড়ে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে বাড়তি এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হতে পারে।

কাঠামোগত মানদণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশকে এ মাসে পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হবে এবং এর বেশিরভাগই রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত।

শর্তের অংশ হিসেবে ব্যক্তিগত আয়কর, করপোরেট আয়কর ও মূল্য সংযোজন করের ক্ষেত্রে দেওয়া ছাড়ের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে বাংলাদেশ।

সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আইএমএফের সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকীকরণের প্রথম ধাপ শেষ করতে হবে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস মোকাবিলায় আমরা বিনিময় হারকে বাজার-ক্লিয়ারিং স্তরে পুনর্বিন্যাস করেছি এবং একই সঙ্গে আইএমএফের সুপারিশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিনিময় হারের নমনীয়তার জন্য ক্রান্তিকালীন সময়ের পদক্ষেপ হিসেবে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি গ্রহণ করেছি।'

তিনি বলেন, আইএমএফের সহায়তায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও সুরক্ষিত রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হবে দেশকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ভ্যাটের আওতায় কর কমপ্লায়েন্স ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান গ্রহণ করতে হবে। এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর অন্তর্ভুক্ত করে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল চূড়ান্ত করা হবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পাঁচটি খাতের জন্য সেক্টর স্ট্র্যাটেজি পেপারস ও মাল্টি ইয়ার পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম প্রণয়ন করবে।

সরকার একক দল দ্বারা প্রতিটি ব্যাংকের তদারকি সম্পর্কিত অর্গানোগ্রাম সহজ করবে। এটি ব্যাসেল নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নন-পারফর্মিং এক্সপোজার এবং সহনশীলতার বিষয়ে একটি আপডেট প্রবিধান জারি করবে।

২০২৫ সালের জুনের মধ্যে সুদ পরিশোধ, ভর্তুকি, ঋণ, ইক্যুইটি ও দায় বাদে অন্তত ৫০ শতাংশ সরকারি লেনদেন ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তরের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়কে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর (এসওই) বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। এটি কমপক্ষে ৪০টি এসওইর আর্থিক বিষয়ে বিশদ বিশ্লেষণ থাকতে হবে।

মন্ত্রী বলেন, এ ছাড়া মুদ্রানীতির অবস্থান আরও কঠোর করতে এবং মুদ্রানীতি সংকোচনে সহায়তা করতে রাজস্ব নীতি পুনর্বিন্যাস করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্টোইনেট এম সায়েহ বলেন, বাহ্যিক স্থিতিস্থাপকতা পুনর্নির্মাণ এবং মুদ্রাস্ফীতি কমানোর দিকে সরকারের মনোনিবেশ করা উচিত।

বিনিময় হার পুনঃনির্ধারণ এবং নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

'ক্রলিং পেগের পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি কঠোর করা হলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সাহায্য করবে।'

 

Comments