ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি কাদের, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করণীয়

ছবি: সংগৃহীত

নারীরা যত ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, এর মধ্যে অন্যতম ওভারিয়ান ক্যানসার। বাংলাদেশেও এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ছে বলে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে।

ওভারিয়ান ক্যানসার সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের ইউনিট প্রধান অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস জোনাকী।

ওভারিয়ান ক্যানসার কী ও ধরন

অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, নারীদের প্রজননতন্ত্রের একটি অংশ হচ্ছে ডিম্বাশয়। জরায়ুর দুই পাশে ফ্যালোপিয়ান টিউব দিয়ে দুইটি ডিম্বাশয় থাকে। এই ডিম্বাশয়কে ওভারি বলে। ওভারিতে যে ক্যানসারের উৎপত্তি হয়, তাকে ওভারিয়ান ক্যানসার বলে।

ওভারির কাজ হচ্ছে ডিম্বাণু ও হরমোন তৈরি করা। ওভারি এমন একটি অর্গান যেটি তৈরি হয় তিন ধরনের কোষ দিয়ে। যেমন: এপিথেলিয়াল, জীবাণু ও স্ট্রোমাল কোষ। প্রতিটি কোষ বিভিন্ন ধরনের টিউমারের জন্ম দিতে পারে।
ওভারির বাইরের আবরণকে বলে এপিথেলিয়াল। ওভারির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় এপিথেলিয়াল ওভারিয়ান ক্যানসার। ৯০ ভাগ ক্যানসারই হচ্ছে এপিথেলিয়াল ওভারিয়ান ক্যানসার।
ডিম্বাণু যেখান থেকে তৈরি হয়, সেটাকে বলা হয় জার্ম সেল বা জীবাণু কোষ। সেখানেও ক্যানসার হতে পারে। জীবাণু কোষ থেকে ক্যানসার হয় শতকরা তিন থেকে পাঁচ ভাগ। এটা অল্প বয়সে হয়।

আর যেখান থেকে হরমোন তৈরি হয়, ওভারির ওভাম বা রক্তনালী যেখানে বিন্যস্ত থাকে, তাকে বলা হয় স্ট্রোমা। সেখান থেকেও ক্যানসার হতে পারে। স্ট্রোমাল কোষে ক্যানসার দুই থেকে তিন শতাংশ নারীদের হয়। সব বয়সেই এটা হতে পারে।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, বিশ্বে নারী প্রজননতন্ত্রের যত ধরনের ক্যানসার আছে, তার মধ্যে কমন দিক বিবেচনায় ওভারিয়ান ক্যানসার চতুর্থে আছে। বিশ্বে ওভারিয়ান ক্যানসারে প্রতি এক লাখে ছয় দশমিক ছয় জন আক্রান্ত হয় এবং চার দশমিক দুই জন মারা যায়। বাংলাদেশে ওভারির ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর এই ক্যানসার এক দশমিক আট শতাংশ হারে বাড়ছে, যা আশঙ্কাজনক।

কেন হয়, কাদের ঝুঁকি বেশি

১. জেনেটিক কারণে ওভারিয়ান ক্যানসার হতে পারে। অনেক নারী বংশগতভাবে জিনের মধ্যে ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি বহন করে যাচ্ছেন। ওভারির ক্যানসারের জন্য ১৫ শতাংশ দায়ী জেনেটিক কারণ। পরিবারে ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ অর্থাৎ মা, বোনের মধ্যে কারো যদি অল্প বয়সে ওভারিয়ান ক্যানসার বা স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের ওভারিয়ান ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

২. বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওভারিয়ান ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

৩. যাদের মিনার্কি বা বয়ঃসন্ধিকাল অনেক আগে হয় এবং যাদের মেনোপজ দেরিতে হয়, তাদের হতে পারে৷

৪. যাদের সন্তান হয় না, তাদেরও ঝুঁকি থাকে।

৫. উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া এবং যাদের বিএমআই ৩০ এর বেশি।

৬. যারা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নিচ্ছেন, তাদের হতে পারে। মেনোপজের পর যদি কেউ শুধুমাত্র ইস্ট্রোজেন কনটেনিং হরমোন থেরাপি নেয়, তাদের ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। প্রতি মাসে নারীদের ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বা ওভাম নির্গত হয়, একে ওভুলেশন বলে। যাদের এই ওভুলেশন অনেক বেশি হয়, তাদের ওভারির বাইরের আবরণ এপিথেলিয়ালে ইনজুরি হয়। সেই ক্ষত ওভারিয়ান ক্যানসারের অন্যতম কারণ।

লক্ষণ

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ওভারির তিন ধরনের কোষকলা থেকে তিন ধরনের ওভারিয়ান ক্যানসার হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো লক্ষণ থাকে না। ৮০ শতাংশ রোগীই আসেন অ্যাডভান্সড স্টেজে এবং নন স্পেসিফিক লক্ষণ নিয়ে। যেমন:

১. ক্ষুধামন্দা, খেতে ইচ্ছে করে না, অল্প খেলেই পেট ভরে যাওয়া।

২. দুর্বলতা, ক্লান্তি লাগা, ওজন কমে যাওয়া।

৩. ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা।

৪. সহবাসের সময় ব্যথা হওয়া।

৫. কারো কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া হয়।

৬. পেট ফুলে যাওয়া, পেটে চাকা অনুভূত হওয়া, অবিরাম একটা নিস্তেজ ভাব ও ব্যথা হয়, অনেক সময় সিভিয়ার পেইন হওয়া।

৭. ওভারিয়ান ক্যানসারের অ্যাডভান্সড স্টেজে যদি পেটে পানি চলে আসে, সেক্ষেত্রে দেখা যায় রোগী বসতে পারে না, বাওয়েল অবস্ট্রাকশন এমনকি শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।

চিকিৎসা

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ওভারিয়ান ক্যানসার নীরব ঘাতক। প্রাথমিক পর্যায়ে সেরকম কোনো লক্ষণ থাকে না। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার পর প্রকাশ পায়। রোগীর পুরো পেট বা তলপেটে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ক্যানসার শনাক্ত করা যায়। পরবর্তীতে আরও অ্যাডভান্সড কিছু ইমেজিং যেমন: সিটি স্ক্যান, এমআরআই করে নিশ্চিত হতে হয় ক্যানসারের উৎস, ধরন ও প্রকৃতি কেমন। এর সঙ্গে টিউমার মার্কার করতে হয় কী ধরনের ওভারিয়ান ক্যানসার, ওভারি নাকি অন্য কোনো অর্গান থেকে হয়েছে তা জানার জন্য।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ক্যানসারের চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি। ওভারিয়ান ক্যানসারের প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে সার্জারি। সার্জারির মাধ্যমে ওভারিয়ান ক্যানসার কোন স্টেজে আছে তা বুঝতে পারা যায়, স্টেজিং করতে সুবিধা হয়। সার্জারির পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয়৷ সার্জারির এক মাসের মধ্যে কেমোথেরাপি শুরু করতে হয়। খুব অ্যাডভান্সড স্টেজের কিছু রোগী আছে যারা সার্জারির জন্য ফিট না, তাদের প্রথমে কেমোথেরাপি এবং পরে সার্জারি করা হয়।

সম্প্রতি নতুন নতুন ড্রাগ আবিষ্কারের ফলে ওভারিয়ান ক্যানসার থেকে সারভাইভাল রেট বাড়ছে। যেমন: টার্গেটেড থেরাপি, হরমোন থেরাপি ও ইমিউনো থেরাপি। যদিও ইমিউনো থেরাপি একটু ব্যয়বহুল। বর্তমানে সবগুলো চিকিৎসা পদ্ধতিই দেশে পাওয়া যায়।

প্রতিরোধ

ওভারিয়ান ক্যানসার প্রতিরোধে কর্মক্ষম থাকতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। ভিটামিন এ, বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার, বিভিন্ন সয়া ফুড বা ন্যাচারাল ইস্ট্রোজেন, ফল ও শাকসবজি খেতে হবে।

ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল বা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি যদি কেউ পাঁচ বছর টানা খায়, তাদের ওভারিয়ান ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

একাধিক সন্তান এবং সন্তানকে এক বছরের বেশি বুকের দুধ খাওয়ান যেসব মা, তাদেরও ঝুঁকি কমে।

ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভদের মধ্যে ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। তাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক টেস্ট করা যেতে পারে। যেসব নারী জিনের মধ্যে ওভারিয়ান ক্যানসার বংশানুক্রমে বহন করছে, সেটি আগে থেকে শনাক্ত করতে পারলে ওভারি রিমুভ করা যেতে পারে ক্যানসার প্রতিরোধে।

খাওয়ার অরুচি, পেটে চাকা, ব্যথা হওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, প্রস্রাবের সমস্যা যদি এক বছর ধরে প্রতি মাসে ১২ দিনের বেশি থাকে, তাহলে অবশ্যই গাইনোকোলজিস্ট বিশেষ করে গাইনি অনকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। যেসব নারীদের ওভারিয়ান ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি আছে, তাদের বছরে একবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার জন্য। দ্রুত রোগ শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসায় ওভারিয়ান ক্যানসার অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। একইসঙ্গে গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের সবাইকে কিশোরী বয়স থেকেই ওভারিয়ান ক্যানসার বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago