মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের নিয়ম, সুবিধা ও কিছু ভ্রান্ত ধারণা

জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী।
মেন্সট্রুয়াল কাপ
ছবি: সংগৃহীত

আজকাল বিশ্বজুড়েই আলোচনায় মেন্সট্রুয়াল কাপ। পিরিয়ডের সময় অনেকেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের দারুণ একটি বিকল্প হিসেবে দেখছেন এটিকে। এই মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের অনেক সুবিধা থাকলেও দেশে কারো কারো মধ্যে এটি নিয়ে ভীতি এবং ভ্রান্তি রয়েছে। ফলে তারা এটি ব্যবহার করতে চান না বা ভয় পান।  

মেন্সট্রুয়াল কাপ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হবে আজ। জানাবেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী

মেন্সট্রুয়াল কাপ কী

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, মেন্সট্রুয়াল কাপ মেডিকেল গ্রেড সিলিকনের তৈরি এক ধরনের বিশেষ কাপ। কাপের মুখটা চওড়া, নিচের দিকটা আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে সরু হয়ে গেছে অর্থাৎ মেন্সট্রুয়াল কাপের আকৃতি ফানেলের মত। ফানেলের মত কাপে জমা হয় পিরিয়ডের রক্ত।

 

মেন্সট্রুয়াল কাপ কীভাবে ব্যবহার করবেন

মেন্সট্রুয়াল কাপ ভাঁজ করলে চ্যাপ্টা হয়ে যায়। খোলা অংশ ভাঁজ করে তিনকোণা করে নিচের অংশ ধরে মাসিকের রাস্তায় আস্তে আস্তে করে যোনিতে প্রবেশ করাতে হবে। ভেতরে গিয়ে প্রসারিত হয়ে জরায়ু মুখে আটকে যায় মেন্সট্রুয়াল কাপ। এর ফলে চারদিক থেকে রক্ত লিকেজ হবে না, সব রক্ত কাপের মধ্যে পড়বে।

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার না করে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা ভালো। আর স্যানিটারি ন্যাপকিনের তুলনায় মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা আরও বেশি ভালো। মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার নির্ভর করে নারীর বয়সের ওপর, তার হাইমেন কেমন, যেমন- বয়ঃসন্ধিকাল, মাত্র মাসিক শুরু হয়েছে এমন কারো জন্য এই কাপ ব্যবহার একটু কঠিন হবে। যদিও বিভিন্ন সাইজের মেন্সট্রুয়াল কাপ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কে কতখানি মেনে চলেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে।

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের সুবিধা

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক আগে থেকেই নারীরা মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করেন। আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে এই কাপের ব্যবহার চালু হয়নি। কিছু কিছু নারীরা ব্যবহার করেন। মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে অনেক সুবিধা রয়েছে। যেমন-

১. মাসিকের সময় মেন্সট্রুয়াল কাপ ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লিকেজের টেনশন ছাড়া টানা ব্যবহার করা যায়। এমনকি অনেক সময় ১২ ঘণ্টা পর্যন্তও এটি ব্যবহার করা যায়।

২. মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে এর ওপর অন্য আর কিছু ব্যবহার করতে হয় না। স্যানিটারি প্যাডে ব্যবহারে অনেক সময় মেয়েদের দুপাশে ঘা হয়ে যায়।

৩. একবার মেন্সট্রুয়াল কাপ কেনার পর পরিষ্কার করে যত্ন করে রাখলে ৫ থেকে ১০ বছর ব্যবহার করা যায়, মেয়াদ উর্ত্তীণ হওয়ার আগ পর্যন্ত। প্রতিমাসে কিনতে হয় না, খরচ বাঁচে।

৪. স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের পর তা কোথায় ফেলতে হবে তা নিয়ে যে বিড়ম্বনা, মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে সেটির সম্মুখীন হতে হয় না নারীদের। যত্রতত্র ফেলতে হয় না। ঝামেলাহীন ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের অসুবিধা

১. মাসিকের সময় মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা অনেকের কাছে অস্বস্তিকর ও ভয়ের ব্যাপার। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের ক্ষেত্রে, যাদের প্রথম মাসিক হয়েছে।

২. হাইমেন পর্দা ছিঁড়ে যাবে এমন ধারণা পোষণ করেন অনেকে, তাই মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করতে চান না।

৩. প্রথমবার মেন্সট্রুয়াল কাপ কেনার সময় খরচ বেশি পড়ে। যদিও একবার কিনে নিলে সেটি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করা যায়।

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে সতর্কতা

১. প্রথমবার ব্যবহারের সময় ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।

২. মেন্সট্রুয়াল কাপ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই সম্পর্কে ছোট করে হলেও প্রশিক্ষণ দরকার। মেন্সট্রুয়াল কাপ কীভাবে ফোল্ড করা হবে, কীভাবে প্রবেশ করাতে হবে বিষয়গুলো শিখতে হবে।

৩. যাদের মাসিকে অতিরিক্ত ফ্লো তাদের ৩ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে মেন্সট্রুয়াল কাপ চেঞ্জ করতে হবে। অর্থাৎ কাপ বের করে রক্ত ফেলে দিয়ে ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিয়ে আবার ব্যবহার করতে হবে। কার কেমন ফ্লো সেটি মাথায় রেখে কাপ চেঞ্জ করতে হবে।

৪. মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় সর্তক না হলে ইনফেকশন হতে পারে।

৫. মাসিক শেষ হয়ে যাওয়ার পর মেন্সট্রুয়াল কাপ অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। পলিথিনে বা অন্য কোথাও সযত্নে রেখে দিতে হবে পরবর্তী মাসিকের সময় ব্যবহারের জন্য।

৬. মেন্সট্রুয়াল কাপের মেয়াদ কতদিন আছে সেটি দেখে ততদিন তা ব্যবহার করতে হবে।

হাইমেন পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার ধারণা কতটা সত্যি

ডা. সাহানার চৌধুরী বলেন, হাইমেন পর্দা ছিঁড়ে যাবে এমন ভীতির কারণে অনেকে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করতে চান না। হাইমেন হচ্ছে মাসিকের রাস্তায় প্রবেশের আগে একটা রিংয়ের মত। বয়ঃসন্ধিতে থাকা নারীদের এই রিং শক্ত থাকে, বিভিন্ন কারণে তা হালকা লুজ হতে পারে। তবে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে হাইমেন পর্দা ছিঁড়ে যায় এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। এটি ব্যবহারের সঙ্গে হাইমেন ছেঁড়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, মেন্সট্রুয়াল হাইজিনের ওপর নির্ভর করে যোনিপথ ও জরায়ুর ইনফেকশন এমনকি এন্ডোমেট্রিওসিস হয়। মাসিক স্বাস্থ্যবিধি বিস্তৃত করতে চাইলে মেন্সট্রুয়াল কাপের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কারণ এটি অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত।

 

Comments

The Daily Star  | English

The psychological costs of an uprising

The systemic issues make even the admission of one’s struggles a minefield

7h ago