বিদেশি বিনিয়োগ কেন কমছে

জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইজেড, বিদেশি বিনিয়োগ, এফডিআই,

বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে ভালো জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, অনেকগুলো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলেছে এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেভাবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পাচ্ছে না।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২২ সালের ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ১৪ শতাংশ কম।

তাছাড়া নতুন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। ২০২৩ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পুনঃবিনিয়োগ। অর্থাৎ বর্তমান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ এফডিআই এসেছে।

অথচ সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনামে ১৫ বিলিয়ন ডলার।

পার্শ্ববর্তী দেশের এই অগ্রগতি দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে বাংলাদেশ কেন বছরের পর বছর ধরে কম এফডিআই পাচ্ছে?

এর বড় কারণ নীতিনির্ধারকদের চিন্তাভাবনা ও বিনিয়োগকারীদের সমস্যার মধ্যে বিরাট ব্যবধান। আর এখন পর্যন্ত সরকার এই সমস্যাগুলো সমাধানে তেমন কাজ করেনি।

যাইহোক যদি বিনিয়োগকারীদের দুর্ভোগগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে যে কারো মনে হতে পারে, তারা কেন এ দেশে বিনিয়োগ করবে। কারণ বাংলাদেশের চেয়ে অন্যান্য দেশে তাদের জন্য বিনিয়োগ করা সুবিধাজনক। সুতরাং তাদের সামনে বিকল্প থাকতে, কেন বাংলাদেশকে বেছে নেবে?

অবশ্য নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের বড় একটি উৎস। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন। তাদের জন্য বিশেষ অঞ্চল তৈরি করতে পারলে দেশে ভালো এফডিআই আসবে বলে তাদের ধারণা।

কিন্তু নীতিনির্ধারকদের এই ধারণা কতটা যুক্তিসঙ্গত? কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সস্তা শ্রম কী যথেষ্ট, একদমই নয়!

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত, কেবল সস্তা শ্রমের প্রস্তাব দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর বড় কারণ বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি শ্রমিকের ভূমিকা নিচ্ছে।

অন্যদিকে, অনেক দেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুরো মূলধন প্রত্যাবাসনের সুযোগ দেয়। শুধু তাই নয় তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সহজে বিশাল পরিমাণে জমি দিয়েও সহায়তা করে।

আর বাংলাদেশে এখনও বিনিয়োগকারীদের নানাবিধ সমস্যা পোহাতে হয়, যার কোন সমাধান হচ্ছে না।

বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ নয়। তাই বাংলাদেশ যদি আরও বেশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়, তাহলে বন্দরের ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

এছাড়া টেকসই জ্বালানি সরবরাহ বাংলাদেশের জন্য আরেকটি উদ্বেগের কারণ। ইতোমধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে তাদের ব্যবসা চালু রাখতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ পেতে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।

বিদেশে বিনিয়োগকারীদের আরেকটি মাথাব্যথা হলো বাংলাদেশে ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন। কারণ একটি দেশ যখন ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন করে তা ব্যবসায়ে প্রভাব ফেলে।

মানছি, নীতি পরিবর্তন কিংবা কাটছাঁট করা অনেক সময় সঙ্গত কারণে দরকার হয়। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নীতি পরিবর্তনের আগে সাধারণত বেসরকারি খাতের অংশীদারদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনাও করা হয় না।

তাই ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন কেবল অনিশ্চয়তা তৈরি করে না বরং ব্যবসায়ের মুনাফাতে প্রভাব ফেলে এবং বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে সংকট তৈরি করে।

একইভাবে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক কর নীতি ও ব্যবস্থার দাবি করে আসছে। কিন্তু সরকার প্রায় প্রতি অর্থবছরেই কর নীতিতে পরিবর্তন আনে।

ওপরে উল্লেখিত কারণ ছাড়াও কম বিদেশি বিনিয়োগের আরেকটি বড় কারণ এখানকার দুর্নীতি। বলছি না বিদেশে দুর্নীতি হয় না, বিদেশেও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশে সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, যারা বড় ধরনের প্রভাব আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বহুজাতিক কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, তাদের কোম্পানি যে প্রধান সমস্যায় পড়ে তা হলো ঘুষ। কিছু কাজের জন্য সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ দাবি করেন।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় রাজনীতিবিদরাও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে।

'একটি বিদেশি কোম্পানি ঘুষ হিসেবে কোনো টাকা দিতে পারে না। কারণ তারা আর্থিক প্রতিবেদনের বাইরে কোন খরচ করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে ঘুষ ও চাঁদাবাজি একটি তিক্ত বাস্তবতা।'

'বাংলাদেশে প্রতিটি ধাপে সুশাসনের অভাব বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'এই ধরনের বাধা শেষ পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর জন্য সমস্যা তৈরি করে এবং অন্যরা তা দেখে বিনিয়োগের আগ্রহ হারায়। অনেক বিনিয়োগকারী দুর্নীতি ও ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনে সত্যিই বিরক্ত হয়ে পড়েছে।'

এখানে উল্লেখ্য, অন্তত ১৭ বছর পর ২০২২ সালে এফডিআই স্টক কমতে শুরু করে। তখন এফডিআই স্টক ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কমে যায়। ২০২৩ সালে এফডিআই স্টক ১ শতাংশ কমে ২০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

একই সময়ে শেয়ারের দরপতন হচ্ছে, বিলগ্নিকরণ বাড়ছে। ২০২৩ সালে এফডিআই বিলগ্নিকরণের পরিমাণ ছিল ৯৬৫ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যবসাবান্ধব সরকারি নীতি অপরিহার্য।

তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানো, ইপিজেড ও হাইটেক পার্কে কর অব্যাহতিতে ধারাবাহিক অর্থ প্রদান ও প্রণোদনা এবং সহযোগিতামূলক নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রয়োজন।

তিনি বলেন, 'নীতিতে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন, অর্থাৎ এটি নিশ্চিত করতে হবে যে- হঠাৎ কোনো পরিবর্তন করা হবে না।'

'দেশের রাজস্ব আহরণ নীতি অবশ্যই বাণিজ্য ও বিনিয়োগমুখী করতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

জাভেদ আখতার বলেন, 'বিনিয়োগকারীদের সেবা আরও উন্নত করতে হবে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করতে হবে।'

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের বোঝার সময় এসেছে শুধু বিদেশিদের সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগের অনুরোধ করলেই বিনিয়োগ আসবে না।

Comments

The Daily Star  | English

World approves $300 bn for poor nations in climate deal

Nearly 200 nations approved Sunday a climate deal that raises to at least $300 billion a year the amount wealthy historic polluters pay poorer countries to take action against global warming

1h ago