জ্বালানি রূপান্তর: ভোক্তার জ্বালা না উপশম?

বিপদ বাড়ছে!

প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্ক একটা অদ্ভুত সুতোয় বাঁধা। প্রকৃতি থেকে সম্পদ নিয়ে, প্রকৃতিকে বশ বানিয়ে সভ্যতার উন্নতি বা অগ্রসরমানতা লাভ করতে হয়। আবার এই সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি যখন নীতি, নৈতিকতা, প্রাকৃতিক নিয়ম, সহনশীলতা ছাড়িয়ে যায়, তখন প্রকৃতি বৈরী আচরণ করে। সেটা আবার মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে মানুষের লোভ, মুনাফা, ভোগ, অপচয় যখন সীমাহীন হয়ে পড়ে, নীতি-নিয়মের বালাই মানে না, তখন মানুষের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে প্রকৃতি। সেই ক্ষতি কখনো কখনো এমন জায়গায় পৌঁছে যায়, মানুষ ও পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তখন মানুষকে কিছু জরুরি-অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ নিয়ে এই বিপদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হয়। এই প্রচেষ্টারও আবার রকমফের আছে। যারা বড় দেশ, উন্নত দেশ, যাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বেশি, তারা এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের লাভ রেখে, ছোট-দুর্বল দেশগুলোকে বৈষম্যের চাপে ফেলে। নিজেদের লাভের দায়ের ক্ষতি ছোট দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয় অন্যায্যভাবে।

প্রকৃতি ও মানুষের এই চক্র পৃথিবীর আবহমান কাল থেকে আছে। মানুষ যত বিজ্ঞানকে করায়ত্ত করে প্রকৃতিকে বশীকরণ করছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ততই এই চক্র জটিল হয়ে উঠছে। মানুষের লোভ যেমন থামছে না, উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা যেমন নামছে না, বৈষম্য যেমন কমছে না—তেমনেই প্রকৃতির রুদ্ররোষকে থামানো যাচ্ছে না। নতুন নতুন রূপে, নতুন নতুন বিপদ হাজির হচ্ছে মানুষের সামনে। হালে যেমন হাজির হয়েছে ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তন নামের বিপদ।

মানুষের নানা কাজে তৈরি হচ্ছে তাপ, মানুষ বেশি বেশি করে তৈরি করছে কার্বন, সেই তাপ পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। আমাদের পুরো জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্য উৎপাদনে, জীবন চক্রে, নদীর পানিতে, সমুদ্রের পৃষ্ঠে, পাহাড়ের বরফে—সর্বত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপদ নানাভাবে হানা দিচ্ছে। মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে আরও বড় বিপদ সামনে।

এইরকম অবস্থায় খোঁজ শুরু হলো কার্বন নির্গমন বাড়াচ্ছে কে? জানা গেলো বড় বড় দেশগুলো যারা শিল্পায়নে বড় তারা এসব দুর্যোগের বড় কারণ। কীভাবে তারা কার্বন বাড়াচ্ছে আমাদের পরিবেশে? দেখা গেলো, তারা আসলে বড় বড় শিল্প চালাতে বেশি বেশি বিদ্যুৎ তৈরি করছে। সেই বিদ্যুৎ তৈরিতে তারা যেসব উপাদান ব্যবহার করছে, বিপদ লুকিয়ে আছে সেখানেই।

তারা কী দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে? বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে প্রাথমিক জ্বালানি (প্রাইমারি ফুয়েল) দরকার হয় টারবাইন ঘোরাতে। এই টারবাইন ঘুরিয়েই তৈরি করা হয় বিদ্যুৎ। প্রাথমিক জ্বালানি হিসাবে প্রধানত ব্যবহৃত হচ্ছে কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস। এর বাইরেও কিছু উপাদান আছে। তবে মূলত কয়লা-তেল-গ্যাস পুড়িয়েই তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। এই উপাদানগুলো প্রত্যেকেই বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে, বাড়াচ্ছে দূষণ। এই যে পরিবেশ বিনষ্টকারী, জলবায়ুর তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্যকারী প্রাথমিক জ্বালানি—একে বলা হচ্ছে ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি। হালে একে নাম দেওয়া হয়েছে ডার্টি ফুয়েল বা খারাপ জ্বালানি।

মানুষ যখন হিসাব করে দেখলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানির মধ্যেই লুকিয়ে আছে বড় বিপদ, তখন ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে বসে, পৃথিবীর বড় ও ছোট—সব দেশ মিলে সিদ্ধান্ত নিলো, পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই ডার্টি ফুয়েলের ব্যবহার কমাতে হবে।

জ্বালানি রূপান্তর

যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদনই আমাদের সব উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি, তাই এই বিদ্যুতের উৎপাদন তো বন্ধ করা যাবে না। এটা তো দিনকে দিন বাড়বেই। আবার এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে প্রাথমিক জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাই ডেকে আনছে মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বড় বিপদ। তাহলে এর একটা বিকল্প দরকার। তখন মানুষের নজর গেলো আবার প্রকৃতির ওপরই। সূর্যের আলো, পানি, বাতাসসহ আরও বেশ কিছু উপাদান মিলল, যেগুলোর ভাণ্ডার অফুরন্ত, যেগুলো থেকে বিদ্যুতও তৈরি করা সম্ভব পরিবেশকে নষ্ট না করেই। এ বিদ্যুৎ তৈরি করতে যে প্রাথমিক জ্বালানি দরকার হচ্ছে, তা আবার নবায়নও করা যাচ্ছে। এই সূর্যের আলো, পানি, বায়ুসহ যেসব জ্বালানি নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশে ক্ষতিকর কার্বন সরবরাহ করে না, তাদেরকে বলা হচ্ছে ক্লিন বা গ্রিন বা রিনিউয়েবল এনার্জি।

আগেই বলেছি, প্যারিসে ২০১৫ সালে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে আমরা সবাই ডার্টি এনার্জি থেকে ক্লিন এনার্জির দিকে যাবো। ২০৫০ সালের মধ্যে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হবে—সেই সমঝোতাও হলো সবার। এই যে ডার্টি এনার্জি থেকে ক্লিন এনার্জির দিকে যাত্রা—সেটারই নাম দেওয়া হলো এনার্জি ট্রানজিশন বা জ্বালানি রূপান্তর। বাংলাদেশ এখন এই জ্বালানি রূপান্তরের পথেই হাঁটছে আর সবার মতোই।

আমরা কী করছি

বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে আমরা মূলত ব্যবহার করি গ্যাস, তেল, কয়লা। পানি, সূর্যের আলো দিয়ে সামান্য পরিমাণে আমরা বিদ্যুৎ তৈরি করি। আর করি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি। ভারত থেকে আনা বিদ্যুৎও তৈরি হয় মূলত কয়লা থেকে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-২৩ সালে আমরা যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি, তার প্রায় ৫২ শতাংশ গ্যাস, ২৪ শতাংশ তেল, ১১ শতাংশ কয়লা পুড়িয়ে। অর্থাৎ এই ২০২২-২৩ বছরে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৮৭ শতাংশ তৈরি হয়েছে ডার্টি ফুয়েল থেকে। পানি ও সূর্যের আলো থেকে এসেছে মাত্র এক দশমিক ৪৫ শতাংশ বিদ্যুৎ। অর্থাৎ ক্লিন ফুয়েল বা গ্রিন ফুয়েল বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আমরা পেয়েছি মাত্র দেড় শতাংশ বিদ্যুৎ।

ফলে, জ্বালানি রূপান্তরে এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দ্রুত ডার্টি এনার্জি থেকে ক্লিন এনার্জির দিকে যাওয়া। আমাদের নানারকম পরিকল্পনায় নানা টার্গেট তৈরি হয়েছে। মোটামুটি আমরা লক্ষ্য তৈরি করেছি খুব দ্রুত আমরা যাতে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ এই ভালো জ্বালানি বা গ্রিন জ্বালানি দিয়ে তৈরি করতে পারি। অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কপ ২৬ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, 'আমরা আশা করছি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যবহৃত মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস থেকে।'

কাজেই আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে তো বটেই, আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্তেও আমরা এখন জ্বালানি রূপান্তর যাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে দ্রুতই ডার্টি এনার্জি থেকে ক্লিন এনার্জির দিকে যাত্রা শুরু করেছি। যদিও এই যাত্রার গতি খুবই শ্লথ। তবে অচিরেই এই গতিকে আমাদের বাড়াতেই হবে।

ভোক্তার কী হবে

আমাদের বিদ্যুৎখাতে বিশেষত বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি বিশেষ আইন আমরা করেছি। আইনটির নাম 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০'। এই আইনকে অনেকে দায়মুক্তির আইন নামে ডেকে থাকেন। কারণ এই আইনে প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিনা টেন্ডারে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে দর ঠিক করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। দ্রুত গতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই আইনের আওতায় প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আমরা তৈরি করেছি। অন্যদিকে, বিদ্যুতের দাম ঠিক করার যে গণশুনানিভিত্তিক ব্যবস্থা ছিল, সেটাও আমরা বদলে ফেলেছি। ফলে, আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় টেন্ডার ছাড়া কাজ দেওয়ার যেরকম ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, আবার গণশুনানি ছাড়াই ইচ্ছেমতো বিদ্যুতের দাম পরিবর্তনের পথও বানানো হয়েছে। এই যে একমুখী, প্রতিযোগিতাহীন, অস্বচ্ছ, জবাবদিহিতাহীন ব্যবস্থা আমরা তৈরি করেছি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, সেটা বহাল রেখেই বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তরের পথে পা ফেলছে।

প্রশ্ন হচ্ছে—এরকম একটা দায়মুক্তির লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফাভিত্তিক সিস্টেম চালু রেখে, জ্বালানি রূপান্তরের পথে হাঁটলে তা কি ভোক্তাকে স্বস্তি দেবে? উত্তর হচ্ছে, না, তা কখনোই নয়। কেননা ক্লিন ফুয়েল দিয়ে যে বিদ্যুৎ তৈরি হবে, তার দর ঠিক হবে যে সিস্টেমে, সেই সিস্টেমই তো জনবান্ধব নয়। ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে ভোক্তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বিশেষ করে বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে যে বিদ্যুৎ সরবরাহের পথ তৈরি করা হয়েছিল, তা দাম কিংবা সেবা—কোনো নিরিখেই ভোক্তাবান্ধব হয়নি। বরং অনেকে ক্ষেত্রে সেটা ভোক্তার জন্য যন্ত্রণার কারণই ঘটিয়েছে। সুতরাং যে পথে, যে পদ্ধতিতে, যে আইনে, যে নীতিমালায় তেল-গ্যাস-কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করা হচ্ছে, সেই একই পথে হেটে জ্বালানি রূপান্তর বাস্তবায়ন করলে ভোক্তার কোনো উপকারই হবে না। ভোক্তাকে তখন একইরকম লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফার শিকার হতে হবে।

জ্বালানি রূপান্তরকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পরিবেশকে বাঁচাতে হলে, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে নবায়নযোগ্য সবুজ জ্বালানির দিকে আমাদের যেতেই হবে। আবার, ভোক্তা যাতে সাশ্রয়ীমূল্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে সবুজ জ্বালানি পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হলে দায়মুক্তির আইন, গণশুনানিহীন দাম নির্ধারণী ব্যবস্থাসহ অস্বচ্ছ-দুর্নীতিযুক্ত-অদক্ষ-জবাবদিহিতাহীন বর্তমান সিস্টেমকে পাল্টাতেই হবে। নইলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রেও ভোক্তা একইভাবে লুণ্ঠিত হবে, শোষিত হবে। ভোক্তা অন্যায্য দামে, নিম্নমানের অগ্রণযোগ্য সেবা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। ভোক্তার অধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে। ভোক্তা জ্বালানি সুবিচার থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, প্রকৌশলী

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

15h ago