সবুজ জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বছরে লাগবে ১ বিলিয়ন ডলার

ছবি: ইলেকটেক

দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নে প্রতিবছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে এবং বছরে ২১ শতাংশ হারে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) এক গবেষণা বলছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত বছরে প্রায় ৯৩৩ থেকে ৯৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার হবে। ২০৪০ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এই বিনিয়োগ বেড়ে বছরে এক দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।

চলতি মাসেই অন্তর্বর্তী সরকার ২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা সংশোধন করেছে। তারা ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ২০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মাস্টার প্ল্যান ২০২৩-এর পূর্বাভাসের সঙ্গে হিসাব করে গতকাল প্রকাশিত 'ক্যাটালাইজিং রিনিউয়েবল এনার্জি ফাইন্যান্স ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এই গবেষণাটি বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাঁচ হাজার ৮৫১ মেগাওয়াট এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ১৬ হাজার ৫০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন হবে।

বর্তমানে দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা মাত্র এক হাজার ৫৫৯ মেগাওয়াট। ফলে ২০৩০ সালের লক্ষ্য পূরণে অতিরিক্ত তিন হাজার ৮৩১ মেগাওয়াট এবং ২০৪০ সাল নাগাদ আরও ১০ হাজার ৬৫৫ মেগাওয়াট যোগ করতে হবে।

২০০৮ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল, কিন্তু এখনো তা পাঁচ শতাংশের নিচেই রয়ে গেছে।

গবেষণাটির তথ্য মতে, ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান ছিল মাত্র তিন দশমিক ছয় শতাংশ। সোলার হোম সিস্টেম এবং সৌরচালিত সেচ ব্যবস্থার মতো ছোট প্রকল্পগুলো ধরলে মোট উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় মাত্র পাঁচ দশমিক সাত শতাংশে।

জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, অর্থ সংকট ও দুর্বল নীতিনির্ধারণ কাঠামোর কারণে আগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন গবেষকেরা। তারা বলছেন, এসব ঝুঁকি ছাড়াও মুদ্রা ঝুঁকি, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের স্বল্পতা ও অবনতিশীল ঋণমান এই খাতের বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। ছোট প্রকল্পগুলোকেও প্রযুক্তিগত ও কর্মক্ষমতা সংক্রান্ত ঝুঁকি, উচ্চ আমদানি শুল্ক এবং জামানত শর্তের মুখোমুখি হতে হয়।

এসব সমস্যা সমাধান না হলে বাংলাদেশ তার নতুন লক্ষ্যমাত্রাও পূরণে ব্যর্থ হতে পারে বলে সতর্ক করেছে গবেষণাটি।

বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়া ও প্রযুক্তির দাম কমে এলেও বাংলাদেশে এ খাতে বিনিয়োগ সীমিতই রয়ে গেছে।

উদাহরণস্বরূপ গবেষণাপত্রে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়েছে, যার বেশিরভাগই জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভর প্রকল্পে গেছে এবং তাতে ১৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা যোগ হয়েছে।

অন্যদিকে, একই সময়ে নবায়নযোগ্য খাতে বিদ্যুত উৎপাদিত হয়েছে মাত্র এক হাজার মেগাওয়াটের কম। অন্য একটি গবেষণার সূত্রে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।

গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামী দিনে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান উৎস হবে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, যা মোট নবায়নযোগ্য উৎপাদনের ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করবে। সৌর সেচ, বায়ুশক্তি ও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলো অবশিষ্ট চাহিদা পূরণ করবে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতের দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০' বিলুপ্ত করে। পরে সরকারি ক্রয়চুক্তির বিধান মেনে বেশ কিছু সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু এতে খুব একটা সাড়া মেলেনি।

গবেষণাপত্রে বলা হয়, দায়মুক্তি আইন বাতিলের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ভবিতব্য চুক্তিতে সরকারের 'ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্ট' (যেটি বিনিয়োগকারীর অর্থ ফেরত পাওয়ার সরকারি নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করতো) না থাকার কথাও বলা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

গবেষকেরা বিনিয়োগকারীদের জন্য ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্ট পুনর্বহাল করা বা একটি নির্দিষ্ট তহবিল গঠন করার সুপারিশ করেছেন, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সময়মতো অর্থ পরিশোধের নিশ্চয়তা দিবে।

এছাড়া সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সরকারকে উপযুক্ত জমি চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের সমস্যা সমাধানে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল গ্রহণের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের লক্ষ্য বাস্তবায়নে আগামী পাঁচ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বর্তমান বার্ষিক ২৩৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চার থেকে ছয় গুণ বাড়াতে হবে। এজন্য দেশে-বিদেশে পুঁজি সংগ্রহের চেষ্টা বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এতে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English
probe committee for past elections in Bangladesh

Govt launches probe into last 3 national polls

The government has formed a committee to investigate alleged corruption, irregularities and criminal activities in the last three general elections.

3h ago