বগুড়ায় গড়ে উঠেছে গাড়ির বিশাল বাজার

ছবি: স্টার

ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরে বগুড়া শহর গাড়ির (অটোমোবাইল) ব্যবসার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সেখানে প্রতি মাসে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০টি গাড়ি, যার বাজার মূল্য প্রায় ছয় থেকে আট কোটি টাকা।

বগুড়ায় মাত্র দুই বছরে ১৫টি গাড়ির (কার-মাইক্রোবাস) শো-রুম এবং ১৫-২০টি ছোট-বড় কার মেরামতের ওয়ার্কশপ বা গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। এগুলোর আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

বগুড়ার বড়গোলা থেকে মাটিডালি পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার মহাসড়কের দুই পাশে এসব শো-রুম ও ওয়ার্কশপে দিনরাত চলছে গাড়ি বিক্রি ও মেরামতের কাজ। শো-রুম, ওয়ার্কশপ ও গ্যারেজগুলোতে অনেকেরই কর্মসংস্থান হয়েছে।

বগুড়ার এই মার্কেটে মূলত দেশে ব্যবহৃত, জাপানে ব্যবহৃত রিকন্ডিশন এবং সম্পূর্ণ নতুন গাড়ির শো-রুম চালু হয়েছে। আরও অনেক ব্যবসায়ী এখানে নতুন ও রিকন্ডিশন গাড়ির ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

কারা এই গাড়িগুলো কিনছেন, জানতে চাইলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, নতুন গাড়ি মূলত উত্তরবঙ্গের বড় ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ডাক্তার ও আমলারা কিনছেন। রিকন্ডিশন গাড়ির মধ্যে নয় সিটের গাড়ি বা মাইক্রোবাস (নোয়া, হাইচ) কিনছেন মূলত সাধারণ মানুষ, যারা গাড়ি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করতে চান। কিছু নতুন উদ্যোক্তা, যারা গাড়ি কিনে বিভিন্ন কোম্পানিতে ভাড়া দিয়ে আয় করতে চান, তারাও কিনছেন। সেই সঙ্গে কিছু মধ্যবিত্ত, যারা খুব অল্পমূল্যে গাড়ি কেনার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, তারাও আছেন এই তালিকায়।

বগুড়ার এই মার্কেটে সর্বনিম্ন আড়াই লাখ থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনা-বেচা হচ্ছে। এখানে নামি-দামি ব্র্যান্ড, যেমন: বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের পুরোনো গাড়িও বিক্রি হচ্ছে।

করোনা মহামারির সময় থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও দেশে ডলার সংকটের কারণে ঢাকায় গাড়ির ব্যবসা খারাপ হয়েছে এবং খরচ কমাতে বিকল্প জায়গায় গাড়ির ব্যবসা চালু রাখার জন্যও অনেকে বগুড়ায় বিনিয়োগ করছেন বলে দাবি অনেক ব্যবসায়ীর।

তবে উত্তরবঙ্গের এই গাড়ির ব্যবসা ধরতে অনেকে আবার নতুন গাড়ির শো-রুম খুলেছেন। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিখ্যাত অটোমোবাইল জায়ান্ট হুন্দাই ইতোমধ্যে বগুড়ায় তাদের একটি আউটলেট চালু করেছে।

ছবি: স্টার

হুন্দাই-বগুড়া আউটলেটের সার্ভিস ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকায় হুন্দাইয়ের তিনটি সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। এর বাইরে গত নভেম্বরে চট্টগ্রাম এবং মার্চে বগুড়ায় একটি আউটলেট খোলা হয়েছে।'

'বগুড়ার আউটলেটটি আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করিনি। তবে গত মার্চ থেকে আমরা সেবা চালু করেছি। পেইন্ট বুথ থেকে শুরু করে আমাদের সার্ভিস সেন্টারে সব কিছুই আছে। ইতোমধ্যে আমরা দুইটি গাড়ির অর্ডারও পেয়েছি', বলেন তিনি।

দেশের বিভাগীয় শহরগুলো ছেড়ে কেন বগুড়ায় শাখা খুললো হুন্দাই, জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'সহজ করে বলতে গেলে উত্তরবঙ্গের মার্কেট ধরার জন্য আমরা এখানে শাখা চালু করেছি। তা ছাড়া ইতোমধ্যে উত্তরবঙ্গে আমরা প্রায় ৮০টি গাড়ি বিক্রি করেছি। সেই গাড়িগুলো যাতে সহজে সার্ভিস নিতে পারে, সেজন্যও একটা সার্ভিস সেন্টারের প্রয়োজন ছিল। এখন উত্তরবঙ্গে কেউ একটা হুন্দাই কার কিনলে তাকে আর ঢাকায় গিয়ে সার্ভিস নিতে হবে না।'

বগুড়ার জারা কার হাউসের মালিক মনোয়ার ইসলাম বলেন, 'আমি ২০১৯ সালে খুব ছোট করে বগুড়ায় ব্যবহৃত গাড়ির ব্যবসা শুরু করি। এখন প্রতি মাসে আমি ১২-১৪টি গাড়ি বিক্রি করি।'

'বিএমডব্লিউ, মার্সিডিস থেকে শুরু করে অনেক নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি আমি বিক্রি করি। আমার পরে বগুড়ায় প্রায় ১৫-২০টি নতুন শো-রুম চালু হয়েছে। এর বাইরে প্রায় ১৫টি বড় বড় ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে গত দুই বছরে।'

মনোয়ার আরও বলেন, 'বর্তমানে দেশের অনেক জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে এখানে গাড়ির ব্যবসা শুরু করছে। এখন পর্যন্ত একই খাতে সব মিলিয়ে বিনিয়োগ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।'

এসব গাড়ি কারা কিনছেন এবং কীভাবে মার্কেটিং করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি কার ব্লগিং করি। এর পাশাপাশি আমার প্রায় ২০ জন ব্রোকার রয়েছে। সেই সঙ্গে ঢাকায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, এমন ১০০ জন শিক্ষার্থী আমার জন্য দামি ব্রান্ডের গাড়ি সোর্সিং করেন। এই কাজের জন্য আমি তাদের কমিশন দেই।'

'সাধারণত দেশের ৬৪ জেলায় আমি গাড়ি বিক্রি করছি। আমার এখানে আড়াই লাক টাকা থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা দামের গাড়িও বিক্রি করেছি', যোগ করেন তিনি।

বগুড়া একটিভ অটো কেয়ার শো রুমের মালিক মেজবাউল জন্নাত পিয়াস বলেন, 'আমি দেড় বছর হলো এখানে গাড়ির ব্যবসা করছি। আমি মূলত রিকন্ডিশন গাড়ি বিক্রি করি। এখন প্রতি মাসে ৬-৮ গাড়ি বিক্রি করছি। মাসে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় করছি।'

বগুড়ায় কেন গাড়ির ব্যবসা শুরু করলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বগুড়া অলিখিতভাবে উত্তরবঙ্গের রাজধানী। রংপুর-রাজশাহী বিভাগের মানুষ এখানে এসে গাড়ি কিনছে।'

ছবি: স্টার

বগুড়ায় গাড়ির ব্যবসার দ্রুত সম্প্রসারণ সম্পর্কে পিয়াস বলেন, 'বগুড়ায় গাড়ি ব্যবসার কস্টিং কম। এই কারণে ক্রেতারা প্রতিটি গাড়ি ঢাকার তুলনায় এখান থেকে এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত কম দামে কিনতে পারছে।'

'ঢাকায় একটি শো-রুমের সিকিউরিটি দিতে হয় কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। শো-রুমের ভাড়া, গ্যারেজ ভাড়াসহ মেইনটেন্যান্স খরচ অনেক বেশি। ঢাকায় যে টাকা সিকিউরিটি দিতে হয়, সেই টাকায় বগুড়ায় একটা ব্যবসা দাঁড় করানো সম্ভব। ওই কারণে বগুড়া গাড়ির ব্যবসার জন্য উত্তরবঙ্গের মধ্যে একটি সম্ভাবনাময় জায়গায় পরিণত হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এখানে ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ জন্য ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করেছেন। আমার জানামতে, কেউ কেউ ৪০-৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন। তা ছাড়া ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ওয়ার্কশপ খুলেছেন এবং অনেক ভালো ব্যবসা করছেন।'

বগুড়ার ঢাকা অটো স্পেস নামের একটি ওয়ার্কশপের ম্যানেজার আলমগীর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ২০২৩ সালে ঢাকা থেকে এসে এখানে ওয়ার্কশপ চালু করেছি। এখানে ব্যবসা বেশ ভালো হচ্ছে। দিনকে দিন আমাদের এখানে কাজের চাপ বাড়ছে।'

বগুড়া টয়োটা মোটরস শো-রুমের মালিক আবু নাসির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুই বছর আগে বগুড়ায় গাড়ির মাত্র দুইটি শো-রুম ছিল। আমি ব্যবসা শুরু করেছি ২০২২ সাল থেকে। এখন প্রতি মাসে প্রায় ৭-১০টি গাড়ি বিক্রি করছি। আমি মূলত রিকন্ডিশন গাড়ি বিক্রি করি।'

টাঙ্গাইল থেকে বগুড়ার টয়োটা মোটরসে নোহা গাড়ি কিনতে এসেছেন ২৮ বছর বয়সী মেহেদী হাসান অনিক।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ঢাকা থেকে বগুড়ায় গাড়ির দাম কম। তা ছাড়া এখানকার সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি। সেই কারণে বগুড়া থেকে আমি গাড়ি কিনছি।'

আবু নাসির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বগুড়ায় প্রায় সব শো-রুমে কিস্তিতে গাড়ি কেনার সুবিধা আছে। আমরা জিরো ডাউন পেমেন্টেও গাড়ি বিক্রি করছি। এ ছাড়া গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে আমরা ক্রেতাকে ১১-১৩ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে থাকি।'

জারা কার হাউসের মালিক মনোয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে ডলারের সংকট হওয়ার কারণে রিকন্ডিশন গাড়ি বিক্রি বেশি হচ্ছে। তা ছাড়া করোনা মহামারির পরে ঢাকায় গাড়ি ব্যবসাতে মন্দা চলছে। এই কারণে বগুড়ায় বিনিয়োগ করা সহজ হয়েছে এবং মুনাফাও ভালো হচ্ছে। তা ছাড়া ব্যবহৃত গাড়ি খুব অল্প মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে বলে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই গাড়ি কিনছেন।'

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিসের সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত দুই-তিন বছরে বগুড়ায় অনেকগুলো গাড়ির (কার, মাইক্রোবাস) শো-রুম গড়ে উঠেছে। বর্তমানে অনেক টাকা ইনভেস্ট করছেন ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসা দ্রুত বাড়ছে, যা বগুড়ার অর্থনীতির জন্য একটি মাইলফলক।'

Comments

The Daily Star  | English

BNP not in favour of banning any political party: Fakhrul

'Who are we to ban a political party? The people will decide,' says the BNP leader

51m ago