এসএমই মেলায় কম দামে পছন্দের পণ্য
ভাবুন তো—আপনি দোকানে দোকানে ঘুরছেন আর এমন জিনিস খুঁজছেন যা ব্র্যান্ডের দোকানগুলোয় দেখেছেন। আচমকা সেরকম কিছু পেয়ে গেলেন ব্র্যান্ডের পণ্যের চেয়ে অনেক কম দামে।
ভালো চামড়ার একটি বেল্ট ৫০০ টাকায় কেনা যাবে। জাপান ও ইউরোপের দেশগুলোয় রপ্তানিযোগ্য চামড়ার ব্যাগ কেনা যাবে দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায়।
আপনার পছন্দের হাঁড়ি-পাতিল, প্ল্যান্টার, ফুলদানি, ঘর সাজানোর উপকরণসহ নানান ধরনের সিরামিক পণ্য ১৬০ টাকায় কিনতে পারবেন। চমৎকার পাটের ব্যাগ ও চামড়ার কয়েকটি পণ্যের দাম পড়বে ৪০০ টাকা।
গত রোববার উদ্বোধন হওয়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের এসএমই ফাউন্ডেশনের সাত দিনব্যাপী ১১তম জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) মেলায় উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিনন্দন পণ্যগুলো এমন দামে কেনা সম্ভব হচ্ছে।
আজ শনিবার মেলার শেষ দিন। এটি রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও অনেকে বিশ্বাস করেন যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে। আবার অনেকের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলো শীর্ষ ব্র্যান্ডের মানের নয়।
বাস্তবতা হচ্ছে—এই উদ্যোক্তারা তাদের উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতার পাশাপাশি গুণগত পণ্য তৈরি করে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৯ সালে প্রকাশিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট উৎপাদন মূল্য সংযোজনে এসএমইর অবদান ৬৯ দশমিক নয় শতাংশ।
একসময় পাট দিয়ে শুধু বস্তা তৈরি করা হতো। কিন্তু, তরুণ উদ্যোক্তারা তাদের উদ্ভাবনীর মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাটপণ্যে বৈচিত্র্য এনেছেন।
বর্তমানে ব্যাগ, গালিচা এমনকি সাজসজ্জার পণ্যসহ শতাধিক পাটজাত পণ্য দেশে-বিদেশে বিক্রি হচ্ছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৯১২ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এসএমই মেলায় নিজেদের উদ্ভাবিত পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
মেলায় জামদানি ও টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি অলংকার, কৃষি যন্ত্রপাতি, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য ও হস্তশিল্পসহ হাজারো পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে।
সন্দেহ নেই, উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ।
এ ধরনের ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে অনেক শ্রমিক কাজ করেন বলে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের হাত ধরে অনেকের কাজের সুযোগ হচ্ছে। সম্মিলিতভাবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেকোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের তুলনায় জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবসা ও ৫০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
পরিকল্পনা বিভাগের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে দেশের জিডিপিতে এসএমইর অবদান ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান তাদের উত্পাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মাসুদুর রহমান পণ্যের গুণগত মান ও বৈচিত্র্যের প্রশংসা করে বলেন, গত ১৫ বছরে এই ধরনের উদ্যোগের পরিধি ও শ্রমিকদের দক্ষতা অনেক বেড়েছে।
আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো—মেলায় অংশ নেওয়া প্রায় ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নারী।
মেলায় ঘোরার সময় স্টলগুলোর পাশ দিয়ে গেলে বোঝা যায়, প্রত্যেকেরই উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠার পেছনে চমৎকার গল্প আছে।
রংপুরের আহ্লাদ ফ্যাশনের মালিক জুয়েনা ফেরদৌস মিতুল মেলায় নিয়ে এসেছেন স্কুল ব্যাগ, ক্যানভাস, ট্রাভেল ব্যাগ, স্পোর্টস ব্যাগসহ পাটের হরেকরকম পণ্য।
২০১৮ সালে নামমাত্র পুঁজি নিয়ে সীমিত পরিসরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হওয়ার আগে তিনি চলচ্চিত্রের কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি তার উদ্যোক্তা হওয়ার ঘটনাকে অনেকটা বিখ্যাত অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রার সঙ্গে তুলনা করেন। কলম্বাস ইউরোপ থেকে সাগরপথে সরাসরি এশিয়ায় আসার পথ খুঁজতে গিয়ে ঘটনাক্রমে আমেরিকায় চলে আসেন।
মিতুল বলেন, 'একদিন আমি ঢাকা থেকে রংপুরে গিয়েছিলাম আমার বোনকে শতরঞ্জির কারখানা গড়ে তুলতে সহায়তার জন্য। সেখানে গিয়ে আমি পাটজাত পণ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পাই।'
'আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন আমার কাছে মেশিন বা যন্ত্রপাতি ছিল না। ২০২২ সালে ১০টি মেশিন ও ১৩ শ্রমিক নিয়ে কারখানা শুরু করি।'
মিতুল নেদারল্যান্ডস ও জাপান থেকে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ রপ্তানি আদেশ পেয়েছেন উল্লেখ করে আরও বলেন, 'বর্তমানে আমার কারখানায় প্রতি মাসে ৫০ লাখ টাকার পাটজাত পণ্য তৈরি হয়।'
'তবে ব্যবসায় খুব বেশি মুনাফা হয় না' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'বিশ্ববাজারে পণ্য নিয়ে ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন।'
একইভাবে ২০০৭ সালে আনা ফ্যাশন বুটিকের মালিক নার্গিস আহমেদ ডিজাইন ও হস্তশিল্পে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে স্বল্প পুঁজিতে পাট থেকে হাতে তৈরি কুশন কভার তৈরি শুরু করেন।
এখন তার দুটি কারখানা আছে—একটি নারায়ণগঞ্জে ও অন্যটি তার নিজ জেলা মাদারীপুরে।
নার্গিস আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার কারখানায় ২৩০ প্রশিক্ষিত শ্রমিক কাজ করছেন। সেখান থেকে মাসে ৭০ লাখ টাকার পণ্য তৈরি করা সম্ভব।'
তিনি টিস্যু বাক্স, অলংকারের বাক্স, শোপিস ও ব্যাগসহ শতাধিক পরিবেশবান্ধব পাটপণ্য নিয়ে মেলায় এসেছেন।
মেলায় চামড়াজাত পণ্যের দোকানেও ভিড় ছিল। উদ্যোক্তারা সেখানে চমৎকার ও মানসম্মত পণ্য বিক্রি করছিলেন। তারা ডেইলি স্টারকে জানান— তারা এপেক্স, বাটা, বে, আড়ংয়ের মতো বড় দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মিটিয়ে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করছেন।
তাদের মাধ্যমে গত অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩৯৬ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করে। এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি।
ডিজাইন বাই রুবিনার কর্ণধার রুবিনা আক্তার মুন্নী ডেইলি স্টারকে জানান—তিনি পার্স, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগসহ শতাধিক পণ্য তৈরি করছেন।
স্থানীয় খুচরা বিক্রেতা ও রপ্তানিকারকদের চামড়াজাত পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি তিনি জাপান, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেও সরাসরি পণ্য রপ্তানি করছেন।
সিলেটের আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মেলায় নিয়ে এসেছে কৃষি যন্ত্রপাতি। প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে ২৭ ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করছে।
এর পরিচালক ফায়াজ আলীম চৌধুরী ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের চারটি বিক্রয়কেন্দ্র আছে। এ ছাড়াও, তারা তিন শতাধিক ডিলারের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করেন।
এসএমই ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, মেলায় ৩৫০টি প্রতিষ্ঠান শতভাগ স্থানীয় পণ্য প্রদর্শন করছে।
Comments