৬ তারিখে বাজেট দেবো, বাস্তবায়নও করব: প্রধানমন্ত্রী

৬ তারিখে বাজেট দেবো, বাস্তবায়নও করব: প্রধানমন্ত্রী
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা | ছবি: টেলিভিশন থেকে নেওয়া

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আমরা ৬ তারিখে বাজেট দেবো। ইনশাল্লাহ বাজেট আমরা ঠিক মতো দিতে পারবো এবং বাজেট আমরা বাস্তবায়নও করব।'

তিনি বলেন, 'যেহেতু এই যুদ্ধ এবং স্যাংশনের জন্য কিছুটা কৃচ্ছতা সাধন গিয়েছি, এই কৃচ্ছতা সাধনের ফলাফলটা হচ্ছে হয়তো আমাদের জিডিপি যেটা গতবার পেয়েছিলাম, তার চেয়ে কিছুটা কমবেই। সেটাও আমরা পরবর্তীতে উত্তরণ ঘটাতে পারব, সে বিশ্বাস আছে। সেভাবেই আমরা পরিকল্পনা নিচ্ছি।'

আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর রমনায় দ্য ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) মিলনায়তনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২২তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, 'আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। কারও কাছে হাত পেতে নয়।'

পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে যায় মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'জাতির পিতা মাথাপিছু আয় ৯৭ মার্কিন ডলার দিয়ে শুরু করেছিলেন, ২৭৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে মিলিটারি ডিকটেটররা ক্ষমতায় আসে, মার্শাল ল জারি হয় বা খুনি মোস্তাক গং যখন ক্ষমতা দখল করে, এরপর থেকে মাথাপিছু আয় কিন্তু ক্রমাগত কমেছে—বৃদ্ধি পায়নি। ১৯৯১ সালে আমরা যখন অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করি; যদিও আমরা ক্ষমতায় ছিলাম না, সেই পর্যন্ত যদি হিসাব নেন তাহলে দেখবেন মাত্র ছয় ডলা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত মাত্র ছয় ডলার।'

তিনি বলেন, জাতির পিতা যদি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে ৯৭ থকে ২৭৭ ডলারে উন্নীত করতে পারে তখন কেন কমে গেল মাথাপিছু আয়? খুবই পরিষ্কার, গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ধারা ছাড়া আর রাজনীতিবিদের মানুষের কাছে একটা ওয়াদা থাকে। সেটা যদি না হয় এবং একটি পরিকল্পনা যদি না থাকে দেশকে নিয়ে; দেশকে আমি কোথায় নিয়ে যাব। একটা দিক-নির্দেশনা যদি না থাকে, তো সে দেশ এগোতে পারে না। অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কথাই চিন্তা করেছে।'

এ সময় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পঁচাত্তরের পরে এগুলো কোনো কিছু ছিল না। গবেষণাও ছিল না। মিলিটারি ডিকটেটররা ক্ষমতাকে কীভাবে নিষ্কণ্টক করবে, মানুষের ভোট চুরি আর ক্ষমতাকে ভোগ করা। ভোট করাটা তারা ভালো বুঝতো। কোন ব্র্যান্ড পরবে, কোনটা পরবে, প্যারিস থেকে কী আসবে, ইতালি থেকে কী আসবে এগুলো নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিল। একের পর এক আসে আর এই খেলা খেলাই আমরা দেখি।

'এক মিলিটারি ডিকটেটর গিয়ে যখন আরেক মিলিটারি ডিকটেটর আসলো, সে আবার মধ্যপ্রাচ্যের কোন রাজার বাড়িতে কোন চেয়ার দেখল আর কোন সোভা দেখল; সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত। এই ছিল বাংলাদেশের অবস্থা। সরকারে আসার আগেই যখন আমরা বিরোধী দলে, আওয়ামী লীগ দল হিসেবে তখন থেকেই আমাদের কী করণী, আমরা যদি ক্ষমতায় যাই কী করব, সেই বিষয়গুলো চিন্তা করেছি। অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। তাছাড়া আমাদের ঘোষণাপত্র-গঠনতন্ত্রে সেগুলো উল্লেখ করাই আছে। সেভাবেই আমরা দীর্ঘ দিন প্রস্তুতি নিয়েছি,' বলেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, 'একটা মিলিটারি সরকার যখন আসে তখন দুর্নীতিই তাদের রীতি হয়ে যায়। খেলাপি ঋণ—এই কালচারটা কিন্তু ওই মিলিটারি ডিকটেটর জিয়ার আমল থেকে শুরু। কিছু এলিট শ্রেণি তৈরি করা, তাদের কিছু সুযোগ দিয়ে দেওয়া আর তারা জানতো যে লোন নিলে শোধ দিতে হবেই না; আবার তো মাফ হয়ে যাবে। এই যে চিন্তা-ভাবনাটা, চিন্তার যে দৈন্যতাটা, এটাই আমাদের দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আমরা আসার পরে সেই জায়গা থেকে আস্তে আস্তে মানুষকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং অনেকখানি আমরা সফলকাম হয়েছি।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'আমার নির্বাচন নিয়ে খেলার তো শেষ নেই। তার পরেও ১৯৯৬ সালে যখন নির্বাচন হয়, আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, আমরা ক্ষমতায় এসেই সরকারি যেগুলো আছে তো আছেই, সমস্ত বেসরকারি খাতকে আমরা উন্মুক্ত দিই। কারণ আমার লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।'

এ সময় আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি।

চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, 'যে দুর্ভিক্ষের কথা বলে বঙ্গবন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষ একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে যতটা কিন্তু এর পেছনে একটা চক্রান্ত ছিল-নগদ অর্থ দিয়ে কেনা খাদ্যের জাহাজ কিন্তু আসতে দেয়নি। কাজেই এভাবে সৃষ্টি করা হয়েছি। সেই বাসন্তীকে জাল পরিয়ে ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছিল। হ্যাঁ, তখন তো মানুষের কাপড়-চোপড় ছিল না। আমি এসে তখনো দেখি বিদেশ থেকে পুরাতন কাপড় এনে মানুষকে দেওয়া হয়।

'ছিন্ন কাপড়, আদল গায়ে মানুষ আর চুয়াত্তরের একটা দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা হয়। ১৯৮১ সালে আসার পর দেখেছি প্রতি বছর দুর্ভিক্ষ। আমি ছুটে যেতাম, আমরা লঙ্গরখানা খুলেছি আমাদের দলের পক্ষ থেকে। আমরা ত্রাণ বিতরণ করেছি। আর দেখেছি মানুষের অবস্থা। সারি সারি মানুষ, গায়ে হাড় আর চামড়া—কোনো মাংস নেই। মনে হচ্ছে জীবন্ত কংকালগুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে। সেই রংপুরের গংগাচড়া নোহলী ইউনিয়ন, কোথায় গাইবান্ধা, কোথায় কুড়িগ্রাম, প্রতিটি অঞ্চলে আমি নিজে গিয়েছি, এমনকি আমি সেই বাসন্তীর বাড়ি গেছি,' বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি আরও বলেন, 'চিলমারীতে নেমে সেখান থেকে কয়েক মাইল কাদামাটি ভেঙে হেঁটে যেতে হয়েছিল নদীর পাড় দিয়ে। কারণ আর কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। আমি গিয়েছিলাম দেখতে যে, আমার বাবার রক্ত নিয়ে বাসন্তীদের জীবনমান উন্নত হয়েছে কি না বা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে কি না। সেটাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম।

'যে ফটোগ্রাফার ছবি তুলেছিল উত্তরবঙ্গের, তাকে আমি সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম যে, চল দেখে আসি তোমাদের বাসন্তীর অবস্থা। নিশ্চয়ই এত দিনে বাসন্তী খুব ভালো আছে। নিশ্চয়ই সে এখন ভালো বাড়িতে থাকে, ভালো কাপড়-চোপড় পরে। আমি কী দেখেছিলাম, কোনো ঘর না—কোনো রকম একটা ছাপড়া। সেখানে বাসন্তীর মা মাটিতে পড়ে আছে। বাসন্তী মানসিক ভারসাম্যহীন একটা মেয়ে; একটু পাগলা। তখন তো বয়সও হয়েছে একটু। পাশে বসে আছে। মাছি ভনভন করছে। ছেঁড়া কাপড়, ঘর নেই, মাটির মধ্যে পড়ে আছে। তার মা, পাশে বাসন্তী,' বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

তিনি বলেন, 'আমার প্রশ্ন ছিল, যারা এত বদনাম করল, এত সমালোচনা করল, তারা কোথায়? তারা বাসন্তীদের খোঁজ তো নেয় না! বাসন্তীদের এই অবস্থা হলো কেন? আমার বাবার রক্ত নিয়েও বাসন্তী জীবনে পরিবর্তন কেন আসলো না সেটাই আমার প্রশ্ন ছিল।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের প্রবৃদ্ধি কিন্তু প্রায় সাত-আটে চলে এসেছিল। মূল্যস্ফীতি সব সময় নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। কারণ মূল্যস্ফীতি যদি কম থাকে, প্রবৃদ্ধি যদি উপরে থাকে তার সুফলটা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, যখনই এই কোভিড-১৯ দেখা দিলো, তার একটা অতিমারি। অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ। বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলো। বাংলাদেশের কিন্তু আমরা অর্থনৈতিক গতিটা অব্যাহত রাখতে পেরেছিলাম। তখন পাঁচ ভাগ পর্যন্ত আমাদের প্রবৃদ্ধি তুলতে পেরেছিলাম।

'কিন্তু এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, স্যাংশন-কাউন্টার স্যাংশন। এখন আবার গাজায় যুদ্ধ, মানে গাজার ওপর যে ইসরায়েলের হামলা ও গণহত্যা। তার ফলে আজকে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে, পরিচালন ব্যয় বেড়েছে, প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। আমাদের যে সমস্ত জিনিস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়; ডিজেল, পেট্রল, গ্যাস, সার, গম, পেঁয়াজ, আলু অনেক কিছু আনতে হয়। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। তার ধাক্কাটা এখন এসে লাগছে আমাদের। এত দিন আমরা ধরে রেখেছিলাম, এখন সেখানে একটা আঘাত এসেছে,' বলেন তিনি।

গ্রামে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'শিল্প কারখার বিরাট বাজার সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমাদের গ্রাম টুঙ্গিপাড়া এক সময় অজপাড়া গাঁ, ঢাকা থেকে যেতে ২২ ঘণ্টা লাগত। এরপর ফেরি পার হয়ে যেতে হতো। সেই টুঙ্গিপাড়ায় বিদ্যুৎ তো ছিলই না, আর দুই দিন হাটবার। ওই কিছু কিনতে হলে হাটবারে কিনতে হবে। তেমন কোনো দোকানপাটও ছিল না। পাটগাতি বাজার কিছু ছিল টিনের ঘর দেওয়া। ওই অবস্থা। আজকে আপনারা যাবেন, ওই অবস্থা বদলে গেছে। আমাকে বলা হলো, এখন পাটগাতি বাজার থেকে ২০০ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। সেখানে সুপার মার্কেটও হয়ে গেছে। আর এখন তো মানুষকে ছেঁড়া কাপড় পরতে হয় না।

'রংপুর, কুড়িগ্রাম এসব এলাকা যে দুভিক্ষপীড়িত; সেখানে আমাকে রংপুর ডিভিশনের জিওসি একদিন আমাকে গল্প করলেন। সে আসছিল, দেখে কৃষকরা মাঠে বসে খাচ্ছে, ১১টা বাজে তখন। তাদের সাথে কথা হলো, বললো যে আপনারা কি সকালের নাস্তা খাচ্ছেন? বলে যে, না না। নাস্তা খেয়ে আসছি বাড়ি থেকে; পান্তা খেয়ে আসছি। এখন খিদা লাগছে চারটা ভাত খাই, কাজ শেষ করে বাড়ি যেয়ে বিকেলে আবার খাব ভাত। আবার রাতে ঘুমানোর আগে আবার খাব। মানে যারা একবেলা খাবার পেত না, চারবেলা পাচ্ছে। এই জায়গায়টায় নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু এখন একটা উদ্বেগের বিষয় হলো এই যুদ্ধ। কারণ স্যাংশন-কাউন্টার স্যাংশন সব কিছু মিলে সারা বিশ্বব্যাপী যেখানে মূল্যস্ফীতি, সেখানে আপনারা জানেন যে, ডলারের দাম বেড়ে গেল। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে গেল। আমাদেরও খরচ বেড়ে গেল, ঋণের সুদ বেশি দিতে হচ্ছে। সব দিক থেকে একটা প্রচণ্ড চাপ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যে জন্য আমি সারা দেশের মানুষকে আহ্বান করেছি এক ইঞ্চি জমি যেন আনাবাদী না থাকে। আমাদের ফসল আমাদের উৎপাদন করতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago