স্মরণ

আনিসুজ্জামানকে কতটা মনে রেখেছি

আনিসুজ্জামান। স্টার ফাইল ফটো, ২০১৫

ছিলেন সময়ের সেরা মানুষের একজন। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, এছাড়া দেশ ও বিদেশের বহুবিধ প্রতিষ্ঠানে। সমাজকে আলোকিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। দেশকে ভালোবেসেছেন প্রাণ উজাড় করে। শ্রেণিকক্ষ ও এর বাইরে শিক্ষক, উপদেষ্টা ও অভিভাবক হিসেবে পালন করেছেন গুরু দায়িত্ব। তাই নামের সঙ্গে স্যার শব্দটি আঁষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে। আজ এই মহৎ প্রাণের দেহান্তর দিবস।

ইংরেজ শাসিত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আনিসুজ্জামান। ১৯৩৭ সালে কলকাতায়। কিন্তু চিন্তা-ভাবনায় ছিলেন ইংরেজি সংস্কৃতিমনের বাইরে, খাঁটি বাঙালিয়ানার আদ্যোপান্ত। বাংলাদেশের মানুষের সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক। এ কারণেই কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় বসবাস। একজন নির্ভেজাল, সত্যের সারথি স্বল্প পরিসরেই হয়ে ওঠেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের পরম বন্ধু।

সরল প্রাণের সজীবতা বাংলার সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি প্রাঙ্গণে যুক্ত ছিলেন তিনি। মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন আমৃত্যু। স্বল্পভাষী, সুঠামদেহী, কলকাতার ঢঙ্গে কথাবলা ছিলো তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মানুষের সাথে মিশতেন, কথা বলতেন, পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার আদর্শ তাকে অনন্যউচ্চতায় ঠাঁই দিয়েছিলো। 
 
আনিসুজ্জামান লিখেছেন বিস্তর। গবেষণা, বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ ও সম্পাদনায় তার পারদর্শিতা প্রশংসার্হ। গবেষণা গ্রন্থ-মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, আঠারশতকের বাংলা চিঠি, পুরোনো বাংলা গদ্য, Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity, Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records  প্রভৃতি, সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে সাহিত্যে ও সমাজে, পূর্বগামী, কাল নিরবধি. বিদেশি সাহিত্য অনুবাদের মধ্যে আইন শব্দকোষ উল্লেখযোগ্য। তার লেখার শৈলী সাধারণ। দুর্বোধ্য ও কাঠিন্য পরিহার করে তিনি সরল শৈলীর বিন্যাস ঘটিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ লেখা উপহার দিয়েছেন পাঠককে। 

বাংলা সাহিত্যের সূচনা ঘটে পদ্যের মাধ্যমে। উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের সূচনা। আনিসুজ্জামান এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা করেছেন-'পুরোনো বাংলা গদ্য' গ্রন্থে। উনিশ শতকের পূর্বে অবজ্ঞাত সাহিত্যিক নিদর্শন গৃহীত হয়নি-ধারাবাহিকতাবর্জিত ও ভাবহীন গদ্যের কারণে। তাছাড়া গদ্যের আবির্ভাবের জন্য যে তত্ত্বজ্ঞান ও যুক্তিবোধ এবং পরিশীলন ও মননশীলতার প্রয়োজন, পাশ্চাত্য-প্রভাবের পূর্বে আমাদের দেশে তা সম্ভব ছিল না। পুরোনো বাংলা গদ্যের জ্ঞাত ও নমুনার সঙ্গে কিছু অজ্ঞাতপূর্ব উপকরণ উদ্ধার করে আনিসুজ্জামান দেখিয়েছেন ষোড়শ শতাব্দী থেকে বাংলা গদ্যের কিছু নমুনা। এসব গদ্যে আছে কাজের গদ্য ও ভাবের গদ্যের মিশেলে শৈলী। 

প্রথমে পাওয়া যায় পদ্যের মধ্যে গদ্য তারপর সূত্রাকার রচনা। পরবর্তীকালে সরল, যৌক্তিক, প্রকাশক্ষম ও বিচিত্র গদ্যের আবির্ভাব। এছাড়া বিভিন্ন অনূদিত গ্রন্থে ভাষাব্যবহারের ভিন্ন ভিন্ন রীতির প্রচলন হয়। উনিশ শতকের প্রারম্ভে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত  সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হলে বাংলা গদ্যের বিকাশ পর্ব শুরু হয়। গদ্যের বিশাল সমারোহ পুরোনো গদ্যের ঝাপসা নির্দশন ফিকে করে দেয়। আনিসুজ্জামান পুরোনো বাংলা গদ্যের বিস্মৃত বিষয়গুলো উল্লেখপূর্বক বাংলা গদ্যের আধুনিকতম রূপের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। 

সাহিত্য একান্তরূপে মানস-প্রক্রিয়ায় বাঙময় রূপ হলেও বস্তুগ্রাহ্য জীবনধারার সঙ্গে তার অন্তর্গূঢ় যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন। সাহিত্য বিচারে কেবল প্রসাধনকলা যোগ করলে চলে না তার সঙ্গে প্রয়োজন সাধনবেগ তথা জীবনাচারের সংযুক্তি। দেশ, কাল ও জনজীবনের পরিপুষ্ট রূপ, সাহিত্য-পাঠকের পরিপুষ্টির নামান্তর। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন পণ্ডিতদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও উপকরণের মাধ্যমে শ্রমলব্ধ প্রয়াসে বিভিন্ন রচনা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।

তার স্মৃতিকথার বই পাঠকের অন্তরমনে জায়গা করে নিয়েছে। অনুগৃহীত হৃদয়ে বাসা বুনা কথাগুলি বিন্যস্ত করেছেন এসব লেখায়। কালনিরবধির যাত্রায় স্মৃতির আবডালে নাড়া দেয় পাঠককে। জীবন-কথা শৈলীভঙ্গিতে ভাস্বর হয়ে ওঠা জীবনগল্পের ভাষ্যে পরিণত হয়েছে। ত্রিশটি প্রবন্ধ সংকলন করে লিখেছেন সংকলিত প্রবন্ধের বই। তথ্যের বিপুলতা ও বিষয়বৈচিত্র্যে এসব প্রবন্ধ উপভোগ্য ও নব চেতনার উৎস। 

বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালির ইহজাগতিকতা, ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা তথা নির্ভুল ও নিপূণ পর্যবেক্ষণ। বায়ান্ন'র ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ উপস্থিতির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিও তুলে ধরেছেন তাতে। বাঙালির জাতিসত্তা, আত্মপরিচয় প্রভৃতি দিক অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছেন বলে এসব লেখায় মননধারা ও বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। 

আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের বাস্তবানুগ ও নির্মোহ চিত্র তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের অসীম সাহসের চিত্রও তিনি বিধৃত করেছেন। স্বদেশি আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মত বড় অর্জন সত্ত্বেও বাঙালির ভাষাজ্ঞান ও এর প্রয়োগ করুণ পরিণতির দিকে অগ্রসরমান। আনিসুজ্জামান তার লেখায় এসব আলোচনা সরল ভঙ্গিতে পাঠকের নিকট উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। 

বাংলাদেশের সংস্কৃতির ইতিহাস অন্বেষণে আনিসুজ্জামান এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি সংগ্রাম ও বিপ্লবে তার সব উপস্থিতি। প্রথম আলো ভাষাপ্রতিযোগ আয়োজন করতো। এর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন আনিসুজ্জামান। এমনকি ভাষা প্রতিযোগ শব্দটি তিনিই দিয়েছিলেন। ভাষা প্রতিযোগিতা শব্দটি পূর্ব থেকেই বহুল প্রচলিত হলেও মাত্র কয়েক বছর আগে ব্যবহৃত হতে থাকে ভাষা প্রতিযোগ শব্দটি। 

মৃত্যুদিবসে আনিসুজ্জামানেক নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তা যৎসামান্য, দায়সারা। বিভিন্ন দিবসে যেসব পত্রিকার সাংবাদিকেরা তাকে বিশ্রাম পর্যন্ত নিতে দেয়নি লেখার জন্য-তাকে নিয়ে আজ সে মানের লেখা ছাপেনি। কোনোমেতে পত্রিকার পাতার কোণে স্মরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে- যা না করলেই নয়। বিষয়টি বেদনাদায়ক, দুঃখের। জীবদ্দশায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি গুরুত্বহীন হয়ে ওঠলেন মাত্র চারবছরের ব্যবধানে!

বাংলা একাডেমি গত কয়েক বছরে বেশ কিছু অভিধান ও গ্রন্থ উপহার দিয়েছে। 'প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ' এর মধ্যে অন্যতম। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক। আনিসুজ্জামান ছিলেন এ গ্রন্থের উপদেষ্টা। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন। কাজকেই তিনি মানুষের কল্যাণের বাতায়ন বলে চিহ্নিত করেছেন।  

আনিসুজ্জামানের জীবনে ছিল প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সংযোগ। মানুষের মনের গহীনে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। পাঞ্জাবি পরা, ব্যাগওয়ালা ভদ্রলোকটি ছিলেন অনেকের পরিচিত। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, সেই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার। দেশে ও বিদেশে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, পদ্মভূষণ, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রভৃতি। 

মৃত্যুদিবসে আনিসুজ্জামানেক নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তা যৎসামান্য, দায়সারা। বিভিন্ন দিবসে যেসব পত্রিকার সাংবাদিকেরা তাকে বিশ্রাম পর্যন্ত নিতে দেয়নি লেখার জন্য-তাকে নিয়ে আজ সে মানের লেখা ছাপেনি। কোনোমেতে পত্রিকার পাতার কোণে স্মরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে- যা না করলেই নয়। বিষয়টি বেদনাদায়ক, দুঃখের। জীবদ্দশায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি গুরুত্বহীন হয়ে ওঠলেন মাত্র চারবছরের ব্যবধানে! এ অগ্রহণযোগ্য! 

তার সারথি যারা ছিলেন তারাও তাকে অকৃতজ্ঞের মত ভুলে গেলেন। ভ্রমরের মত গুন গুন করে যারা চারপাশ আবৃত্ত রেখেছিলেন আনিসুজ্জামানকে আজ তারা ব্যস্ত অন্যত্র-নিজকাজে। এরূপ অযাচিত চর্চা সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। যোগ্য মানুষকে যোগ্য স্থানে আসীন করতে হবে। মানুষ মরলেও তার কাজ মরে না। আনিসুজ্জামানের কাজ স্মরণ করা উচিত। অন্তত তার জন্ম ও মৃত্যুদিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রচারের মাধ্যমে।

আনিসুজ্জামান সমাজের দর্পণ। বাঙালির বাতিঘর। দেশ ও মাতৃকার কল্যাণে নিবেদিত আনিসুজ্জামান দেহান্তর হন ২০২০ সালের এই দিনে। তাকে অনুসরণ প্রয়োজন। সারাজীবন মানুষের মুক্তি ও কল্যাণে কাজ করে যাওয়া মানুষটিকে ভুললে আমাদের সংস্কৃতির বড় ক্ষতি হবে। তার লেখা থেকে তরুণ প্রজন্ম অনেক কিছু শিখতে পারবে। 

মূল্যবোধ ও আদর্শের নানাদিক নিয়ে তিনি লিখেছেন। কর্মনিষ্ঠা ও শ্রমনিষ্ঠার নিদর্শন আছে এসব লেখায়। বহুবিধ ও বহুবৈচিত্র্য লেখার ভাণ্ডার থেকে অনেক কিছু জানার আছে, শেখার আছে। সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতি লেখা মানবজীবন গঠনের নির্দেশক। মনীষীদের লেখা পড়ে তা থেকে আদর্শ গ্রহণ করা উচিত। তিনি আমাদের আদর্শবান লেখক ও শিক্ষক। তার মৃত্যু নেই। দেহান্তর আছে কেবল। তার লেখা ও কর্ম বেঁচে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। 

Comments

The Daily Star  | English
Chief Adviser Yunus calls for peace

Yunus condemns attack at Amar Ekushey Boi Mela, orders swift action

In a statement, the chief adviser denounced the violence, emphasising that it goes against the open-minded spirit of the book fair, which honours the language martyrs of February 21, 1952, according to the CA's press wing

4h ago