উপজেলা নির্বাচন: দলীয় প্রতীক, কম ভোট ও বরিশালের চমক
চলমান উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দুটি খবরে আলোকপাত করা যাক—
১. উপজেলা নির্বাচনে এবারই সবচেয়ে কম ভোট।
২. বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভিড়ের মধ্যে সাবেক শিক্ষক জয়ী।
প্রথম প্রশ্ন হলো, এবারের নির্বাচনে ভোটের হার কেন এত কম? মানুষ কি ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, নাকি উপজেলা পরিষদের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কম? জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি উপজেলা পরিষদের আসলে কাজটা কী বা সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম কতটা স্পষ্ট—তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বরিশাল সদর উপজেলার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতাকে হারিয়ে একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি কী করে জয়ী হলেন? এটি কি দলীয় কোন্দলের ফল, নাকি মানুষ সত্যিই ভেবেছে যে একজন নির্দলীয় লোক জয়ী হলে তিনি মানুষের কথা ভাববেন? মানুষ কি তাহলে দলীয় প্রার্থীদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ?
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিধান করার আগ পর্যন্ত, আরও পরিষ্কার করে বললে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতির প্রভাব খাটানোর পরিমাণ ও প্রবণতা যতদিন কম ছিল, ততদিন পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সমাজকর্মী, নির্দলীয় এলিট, স্থানীয়ভাবে পরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অনেকেই জয়ী হয়ে আসতেন।
অনেক সময় দলীয় পরিচয়ধারী অনেক প্রার্থীও এসব নির্দলীয় প্রার্থীর কাছে হেরে যেতেন। কেননা সাধারণ মানুষ তখন ভোট দিতেন ব্যক্তিকে। সামাজিকভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা, তার সততা, মানুষের জন্য তার অবদান ইত্যাদি বিবেচনা করে। কিন্তু যখনই স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে হওয়া শুরু হলো, তখন থেকে এসব নির্দলীয় ভালো মানুষ, নির্দলীয় সমাজকর্মী, নির্দলীয় শিক্ষক, নির্দলীয় ব্যবসায়ীদের জন্য নির্বাচনের দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নির্বাচনী ব্যবস্থাটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে হতে এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই তিনি বিজয়ী। এমনও দেখা গেছে যে, সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়ার পরেই কেউ কেউ বিজয় মিছিলও করেছেন! কারণ তিনি ধরেই নিয়েছেন যে, মনোনয়ন যখন পেয়েছেন, তখন তিনিই জিতবেন।
এসব কারণে বেশ কয়েক বছর ধরেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্দলীয় ব্যক্তিদের জয় পাওয়ার হার খুবই কম। কিন্তু এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের কোনো প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক দেয়নি। দলের স্থানীয় নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নয়।
গত ২২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভা শেষে গণভবন গেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক থাকবে না। ফলে একক দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টিও আর থাকছে না।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের পক্ষে-বিপক্ষে দলের সিনিয়র নেতারাও মতামত দেন। যেখানে বেশির ভাগ নেতা দলীয় কোন্দল ও সংঘাত থেকে নেতা-কর্মীদের দূরে রাখতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতীক না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও নেতাদের এই মতামতের প্রতি নিজের সমর্থন জানান।
প্রশ্ন হলো, স্থানীয় নির্বাচন যদি দলীয় প্রতীকে করার ফলে সংঘাত ও কোন্দল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে কেন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক চালু করা হলো?
কেন দলীয় প্রতীক?
স্মরণ করা যেতে পারে, যখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই আইনটি হয়, তখনই এর সমালোচনা হয়েছিল। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সরকার তখন এই আইনটি করেছিল মূলত স্থানীয় সরকারেও নিজেদের একক আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে। অর্থাৎ নির্দলীয় নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে যাতে সরকারের প্রতি নিঃশর্ত অনুগত নয়, এমন কেউ জয়ী হয়ে আসতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করার জন্য।
কিন্তু তাতে দেখা গেলো, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় যে প্লাটফর্ম, সেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তো বটেই, মেম্বারদেরও অধিকাংশই দলীয় লোক। আর যখন কোনো দলীয় পরিচয়ধারী লোক প্রার্থী হন, তখন স্বভাবতই ওই দলের ভোটার ও সমর্থকদের ওপর তাকে ভোট দেওয়ার একটা নৈতিক চাপ তৈরি হয়। যার ফলে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি কোনো নির্দলীয় লোকের পক্ষে ভোটে জিতে আসা কঠিন। এর আরেকটি কারণ নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি।
এখানে যে প্রশ্নটি করা দরকার তা হলো, যেহেতু এবারের উপজেলা নির্বাচনে মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি অংশ নিচ্ছে না, ফলে আওয়ামী লীগ সহজেই তাদের প্রার্থীদের নৌকা প্রতীক দিয়ে একক প্রার্থীর দরজাটা বন্ধ করে দিতে পেরেছে। কিন্তু বিএনপি যদি এই নির্বাচনে অংশ নিতো, তাহলে কি আওয়ামী লীগ এত সহজে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারতো?
দলীয় প্রতীকের বাইরেও যদি বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা এই নির্বাচনে ব্যাপক হারে অংশ নিতেন, তাহলেও কি আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় প্রার্থীদের নৌকা প্রতীক না দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারতো?
কেন এত কম ভোট?
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, দিনভর ভোটকেন্দ্রগুলোতে খুব একটা ভোটার উপস্থিতি দেখা না গেলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) দাবি করেছে, ভোট দিয়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত ১৩৯টির মধ্যে ১৩৬ উপজেলার ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১১৬ উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী বিজয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র থেকে ৮ জন, বিএনপির ৫ জন, জাতীয় পার্টির ৩ জন, জাতীয় জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ২ জন, ইসলামী আন্দোলনের ১ জন ও আল-ইসলামের ১ জন বিজয়ী হয়েছেন। বিএনপি থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ইতোমধ্যে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এ নিয়ে চতুর্থবার উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে গড়ে ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে।
আর ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা ভোটে ৬১ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভোট পড়ে। সেই হিসাবে গত তিন মেয়াদের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতি ছিল। এর কারণ কী? মানুষ কি ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? উপজেলা পরিষদের সেবা ও অন্যান্য কার্যক্রম নিয়ে তাদের মধ্যে ধোঁয়াশা আছে? নাকি মানুষের আর্থিক অবস্থা এতটাই ভালো হয়েছে যে এখন আর উপজেলা পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানে কে চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান হলেন—তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই?
বরিশালে কেন এই চমক?
বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভিড়ের মধ্যে জয়ী হয়েছেন সাবেক শিক্ষক আব্দুল মালেক। তার রাজনীতি করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বছর দশেক আগে নিয়েছেন অবসর। এরপর অবসর জীবনযাপন করছিলেন। সেখান থেকে চমক দেখিয়ে তিনি হয়েছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
আব্দুল মালেকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিরুল ইসলাম। তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতা এস এম জাকির হোসেন, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মাহবুবুল রহমান। তারা তিনজনই বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক ও সিটি মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের এই কোন্দলের কারণে ভোট ভাগ হয়ে গেছে, যার সুবিধা পেয়েছেন আব্দুল মালেক।
এটি হচ্ছে মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ হলো, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই সাধারণ মানুষকে বেশি যেতে হয়। সেখানে কে কোন দলের সমর্থক, সেটি বিবেচনায় নিয়ে সেবা দিতে গেলে বা সেবা পেতে গেলে বিরাট সামাজিক সংকট তৈরি হবে। কিন্তু যখন থেকে স্থানীয় নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে শুরু হয়েছে, তখন থেকে অনেক জায়গা থেকে এরকম অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিচয়টিই মুখ্য। কিন্তু যখন থেকে এই নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে শুরু হয়েছে, তখন সমাজের নির্দলীয় ভালো মানুষেরা প্রান্তিক হয়ে গেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের মতো তৃণমূলের প্রতিষ্ঠানও দলীয় নেতাকর্মীদের দখলে চলে গেছে। দলীয় বিবেচনার কারণে কমিউনিটির মানুষের মধ্যেও বিভেদ বেড়েছে।
এরকম বাস্তবতায় উপজেলা নির্বাচনে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেভাবে তাদের দলের কোনো প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক না দিয়ে সবার জন্য প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে, সেটির ধারাবাহিতায় স্থানীয় নির্বাচনগুলো আগের মতো দলীয় প্রতীকমুক্ত রাখতে আইনের সংশোধন জরুরি। তাহলে আব্দুল মালেকদের মতো মানুষেরাও জয়ী হয়ে আসতে পারবেন। সমাজে দলীয় মাস্তানি ও রাজনৈতিক বিভেদ কমবে। দলীয় পদ ও টাকার বিরুদ্ধে সমাজের গ্রহণযোগ্য মানুষেরা জয়ী হয়ে আসার সুযোগ পাবেন।
আর এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। তারা যদি মনে করে কেন্দ্র করে তৃণমূল—সর্বত্রই নিজেদের দলীয় লোকদের আধিপত্য থাকবে এবং অন্য কোনো দল বা নির্দলীয় লোকদের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না—তাহলে দেশের রাজনীতি যে তিমিরে আছে, সেখানেই থাকবে। কিন্তু যে এগিয়ে থাকে, পরিবর্তনের সূচনাটা তাকেই করতে হয়।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
Comments