অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩ কঠিন সিদ্ধান্ত

বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ কমে যাওয়ার মতো জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তিনটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব সিদ্ধান্তের একটি হচ্ছে—ডলারের বিপরীতে টাকার দাম আরও সাত টাকা কমিয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। ফলে ডলারের বিপরীতে একদিনে টাকার সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে।

দ্বিতীয়টি হলো—ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। ফলে চার বছর আগে ব্যাংকগুলোর ওপর আরোপিত 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল মেকানিজম' থেকে এটি একটি বড় পরিবর্তন আনা হলো।

এ ছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে আট শতাংশ করেছে। এ নিয়ে এ বছরে দ্বিতীয়বার সুদহার বাড়ানো হলো।

এই তিন সিদ্ধান্ত জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দুটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একটি হচ্ছে ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যটি রিজার্ভ কমে যাওয়া।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা ও রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি। আবার রিজার্ভ পরিস্থিতিও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি। গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ৩৫ শতাংশ কমেছে। রিজার্ভ কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। ফলে দেশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। তাই ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে কর ও কর আদায়ের পরিধি বাড়ানো চেষ্টা করা হচ্ছে।

গতকাল বুধবার ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বাধীন আইএমএফের প্রতিনিধি দল ১৫ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে তৃতীয় কিস্তির ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধি দল এই সফরে ঋণ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এক বিবৃতিতে পাপাজর্জিও বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব উদ্যোগকে 'সাহসী' উদ্যোগ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব সিদ্ধান্তের অন্যতম লক্ষ্য হলো- টাকার বিনিময় হার পুনর্বিন্যাস ও ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করা।

স্মার্ট হার বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন সুদের হার হবে বাজারভিত্তিক।'

যেহেতু নীতি সুদহার সংশোধন করা হয়েছে এবং স্মার্ট হার বাতিল হয়েছে, তাই সুদের হার বাড়তে পারে। এটি ঋণের সুদ বাড়াবে। তাই এই সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাহিদা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। তবে যারা ঋণ নেবেন তাদের জন্য একটি ধাক্কা।

একইভাবে ডলারের বিনিময় হার বাড়িয়ে দেওয়ায় তা রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। কারণ তারা ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাবেন। যদিও আমদানিকারকদের পণ্য আমদানি করতে বেশি টাকা খরচ করতে হবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, 'গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়িক খরচ অনেক বেড়েছে। আমাদের জন্য মানানসই বিনিময় হার জরুরি ছিল। সরকার রপ্তানি আয়ের ওপরও নগদ প্রণোদনা কমিয়েছে।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, 'বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের দিকে যাওয়া সঠিক উদ্যোগ।'

তবে পারটেক্স পেট্রো লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার ঘোষের আশঙ্কা, ব্যাংকিং খাতে সুদের হার ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

গতকাল ঋণের গড় সুদহার ছিল ১৪ শতাংশের কম।

এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ বলেন, 'ব্যাংকগুলো বেশি আমানত পেলে তাৎক্ষণিকভাবে সুদের হার বাড়বে।'

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন মনে করেন, সুদ ও টাকার নতুন বিনিময় হার বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার কমাতে সহায়তা করবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'সুদের হার বাড়ায় অর্থনীতির গতি আরও ধীর হতে পারে। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।'

তার মতে, ক্রলিং পেগ চালুর ফলে টাকা-ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল হবে এবং রিজার্ভ বাড়বে।

প্রবাসী আয়ে ভর্তুকি বন্ধে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'টাকার আরও অবমূল্যায়ন হতে পারে।'

এসব উদ্যোগ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে কি না সে বিষয়ে তিনি বলেন, 'এগুলো প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, তবে যথেষ্ট নয়। আবার এগুলো ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।'

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো স্মার্ট হার প্রত্যাহার।'

'বাজারভিত্তিক সুদের হার নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সময় থেকেই বাংলাদেশ তা মেনে চলছে। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ব্যবস্থায় কার্যক্রম পরিচালনায় যথেষ্ট অভিজ্ঞ।'

বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই কর্মকর্তা মনে করেন, নীতি সুদহার বাড়ানো ঠিক হয়েছে। মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত এটি ঊর্ধ্বমুখী রাখতে হবে।

তবে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।

তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ১১৭ টাকা বেঁধে দিয়ে আনুষ্ঠানিক বিনিময় হারের সঙ্গে বিদ্যমান বাজার দরের ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। এর মাধ্যমে আমরা এক বিনিময় হার থেকে আরেক বিনিময় হারে চলে এসেছি।'

ক্রলিং পেগ চালু হওয়ার আগে থেকেই আমদানিকারকরা প্রতি ডলার ১২০ টাকায় কিনছিলেন উল্লেখ করে তিনি আশঙ্কা করেন, 'এই উদ্যোগটি সহায়ক নাও হতে পারে। উল্টো ফলও বয়ে আনতে পারে।'

অর্থ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী সুদের হার ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো ধাক্কার ফলে রিজার্ভ কমেছে।'

তিনি জানান, এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি দ্রুত সংকটে পড়েছে।

তার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাহসী উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় এটি সত্যিকারের সংস্কার উদ্যোগ।

টাকার নতুন বিনিময় হার ও স্মার্ট হার প্রত্যাহার অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সহায়তা করতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি জানান, বহু দশক ধরে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ১০ শতাংশ। এটি বিশ্বের সর্বনিম্ন।

'আমরা মনে করি, আরও উন্নতির সুযোগ আছে,' যোগ করেন তিনি।

আইএমএফ বলছে, সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে টেকসই রাজস্ব আদায়কে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।

Comments

The Daily Star  | English

Can't afford another lost decade for education

Whenever the issue of education surfaces in Bangladesh, policymakers across the political spectrum tend to strike a familiar chord. "Education is our top priority," they harp

2h ago