সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিবারের

মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের লোগো।

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও তার পরিবারের ছয় সদস্য পরিচালক হিসেবে থেকে বিমা প্রতিষ্ঠানটির অন্তত ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উঠে এসেছে একটি অডিট রিপোর্টে।

কোম্পানিটির বরখাস্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর রাশেদ বিন আমানের অভিযোগের ভিত্তিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) অডিটটি পরিচালনা করে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস অবশ্য কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন।

২০২৩ সালে গোলাম কুদ্দুসকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগসহ ১৭টি অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য আইডিআরএ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অডিট ফার্ম হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়।

সোনালী লাইফ পরবর্তীতে রাশেদকে বরখাস্ত করে। গোলাম কুদ্দুসের বড় মেয়ের সাবেক স্বামী রাশেদ। কোম্পানির টাকা আত্মসাতের মামলায় বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।

অডিট শুরু হওয়ার পর ১৮ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন গোলাম কুদ্দুস।

অডিট প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর আইডিআরএ কোম্পানিটি পরিচালনায় প্রশাসক নিয়োগের কথা ভাবছে।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কোম্পানি ও পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।'

অডিটে দেখা গেছে, গোলাম কুদ্দুস ও তার পরিবারের ছয় সদস্য পরিচালক হিসেবে নিজেদের জন্য শেয়ার ইস্যু, গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন কোম্পানিকে অবৈধ অর্থ প্রদান এবং তার পরিবারের সদস্য পরিচালকদের বেতন পরিশোধসহ বিভিন্ন উপায়ে তহবিল আত্মসাৎ করেছেন।

অবৈধভাবে বিলাসবহুল গাড়ি কেনা এবং গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের সদস্য পরিচালকদের অতিরিক্ত লাভ দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণ ও চিকিৎসার বিলের মাধ্যমে তারা বিপুল অর্থ পকেটে ভরেছে।

তারা গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স পলিসি থেকে অবৈধ কমিশনের মাধ্যমেও মোটা অঙ্কের টাকা আয় করেছে, বলা হয়েছে ওই অডিট রিপোর্টে।

ড্রাগন ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড কমিউনিকেশন লিমিটেড, ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং লিমিটেড এবং ইম্পেরিয়াল সোয়েটার লিমিটেড অস্থাবর সম্পদ কেনার জন্য সোনালী লাইফ থেকে বিভিন্ন সময়ে ১৪১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা পেয়েছে, যার অনুমোদন দিয়েছেন গোলাম কুদ্দুস।

অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, এই ধরনের অর্থপ্রদানের জন্য আইডিআরএর অনুমতি প্রয়োজন হলেও কোম্পানিটি তা নেয়নি, যা অবৈধ।

২০১৮ সালে সোনালী লাইফ প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যে এক কোটি ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যু করে নিজের পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে চেয়েছিল এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর অনুমোদন দেয়।

কিন্তু পরিবারের চার সদস্য পরিচালক নূর-ই-হাফজা, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, এস সোবহান চৌধুরী ও শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েলের কাছ থেকে কোনো টাকা না নিয়েই অভিহিত মূল্যে তাদেরকে নয় কোটি ১৬ লাখ টাকার শেয়ার দেওয়া হয়। এটি করা হয় ২০১৮ সালের ১৪ জুন।

একই দিনে অন্য তিন পরিচালক মায়া রানী রায়, এ রাজীব সামদানী ও হোদা আলী সেলিমের কাছ থেকে শেয়ারপ্রতি ২০ টাকা মূল্য নেওয়া হয়েছে। এই তিন পরিচালক গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের সদস্য নয়।

অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়, গোলাম কুদ্দুস তার স্ত্রী ফজলুতুন নেসার কাছ থেকে ছয় লাখ ২৫ হাজার, ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান ও মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার কাছ থেকে ২৬ দশমিক আট লাখ, সোবহানের স্ত্রী এস সোবহান চৌধুরীর কাছ থেকে তিন লাখ এবং মেয়ের স্বামী ড্যানিয়েলের কাছ থেকে ১২ লাখ শেয়ার পেয়েছেন।

পরে গোলাম কুদ্দুস তার এক মেয়ের কাছে ১৪ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার, স্ত্রীর কাছে দুই লাখ ৩০ হাজার শেয়ার এবং ছেলে ও পুত্রবধূর কাছে ছয় লাখ ৫০ হাজার শেয়ার হস্তান্তর করেন।

এর মাধ্যমে একই পরিবারের সাত সদস্য কোম্পানি বোর্ডে পারিবারিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি করেছে বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বর্তমানে, সোনালী লাইফের ২০ জন পরিচালক রয়েছেন, যাদের মধ্যে সাতজন একটি পরিবারের সদস্য।

কোম্পানির একটি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কোম্পানিটির সাত লাখ ৮৮ হাজার বিমা গ্রাহক রয়েছেন এবং এর পরিশোধিত মূলধন ৪৭ কোটি টাকা। গত বছর কোম্পানিটি বিমার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ৮৩২ কোটি টাকা।

অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী লাইফ আর্থিক আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে কয়েকজন পরিচালকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, ফলে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। এতে বিমাকারী ও গ্রাহকদের ক্ষতি করছে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে ১৮ কোটি টাকা অবৈধভাবে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই গোলাম কুদ্দুসের ব্যক্তিগত ব্যবসা ড্রাগন সোয়েটারের অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়েছিল, যা অবৈধ।

এ ছাড়া, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিমা কোম্পানিটি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৯৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৮৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট হয়ে গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন একটি কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।

অডিট প্রতিবেদনে এটিকে 'জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও আত্মসাৎ' বলে অভিহিত করা হয়েছে।

অডিটে আরও দেখা গেছে, বছরে গড়ে ২২ কোটি টাকা বা মাসে প্রায় দুই কোটি টাকা নগদ ব্যয় করা হয়েছে এবং নগদ চেকের মাধ্যমে বেশকিছু এককালীন বড় লেনদেন করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অর্থ তছরুপের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

কোম্পানিটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভসহ প্রায় সব স্বাক্ষরকারীই গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের সদস্য এবং এর ফলে এসব লেনদেনে তারা কোনো প্রশ্ন তোলেননি।

সীমাবদ্ধতা থাকায় কোম্পানিতে হওয়া অন্যান্য দুর্নীতি এই অডিট প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানির সার্বিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য একটি বিশদ অডিট প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অসম্পূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ বা তথ্য গোপন করা, অস্বচ্ছ অ্যাকাউন্টিং পদ্ধতি এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে গোলাম কুদ্দুস বলেন, এই অডিট প্রতিবেদনের ফলাফল 'অসত্য' এবং তিনি শিগগিরই তার অবস্থান স্পষ্ট করে আইডিআরএকে চিঠি দেওয়ার 'প্রস্তুতি' নিচ্ছেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাবেক সিইও রশিদ বিন আমান কোম্পানিতে যোগদানের পরও কোম্পানিটি ভালো ছিল। তারপর কিছু কারণে তিনি কোম্পানিটি "হোস্টাইল টেকওভার" (নিজের আয়ত্তে) নেওয়ার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করেন। আমাদের কাছে এর প্রমাণ আছে।'

আইডিআরএর তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সোনালী লাইফের সারা দেশে ২৬ হাজার ৬৯৩ জন বিমা এজেন্টসহ ২০৪টি শাখা রয়েছে। এটি ২০২০ সালে মোট বিমা দাবির ৯৯ দশমিক নয় শতাংশ, ২০২১ সালে ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ নিষ্পত্তি করেছে। ২০২৩ সালে কোম্পানিটি ১২২ কোটি ২৬ লাখ টাকার প্রায় সব বিমা দাবি নিষ্পত্তি করেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Doubts growing about interim govt’s capability to govern: Tarique

"If we observe recent developments, doubts are gradually growing among various sections of people and professionals for various reasons about the interim government's ability to carry out its duties."

38m ago