পুরান ঢাকার ‘পারফিউম লেন’

ছবি: পলাশ খান/স্টার

এক বুধবারের বিকেল। হাঁটছিলাম ঢাকার এক ধুলোমাখা রাস্তায়। সেই পরিচিত দৃশ্য—রাস্তায় ময়লার স্তূপ; নোংরা পানি।

শেষ বিকেলের আলো অলিতে-গলিতে। রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দ। বিক্রেতাদের হাঁক-ডাক।

রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় বড় রাস্তা ধরে যতই এগোই, ততই তীব্র সুবাস ভেসে এসে দোল দেয় নাকে। স্বস্তি দেয় সুগন্ধির শীতল বাতাস। গোলাপ-জুঁইয়ের পরিচিত সুবাস এলোমেলো পথে এনে দেয় উদ্যানে হাঁটার বিলাসিতা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দেখতে পেলাম অনেকগুলো দোকান। এখানে রঙিন কাঁচের বোতলে পারফিউম আর আতর। বুঝতে পারলাম এই সুবাস কোনো নির্দিষ্ট দোকানের নয়। বাবুবাজার মোড় থেকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তার সারিবদ্ধ দোকানগুলো থেকে ভেসে এসেছে।

সব সুবাস এসে যেন থমকে দাঁড়িয়েছে মিটফোর্ডের বিখ্যাত সুগন্ধি বাজারে। এটি ঢাকায় পারফিউমের একমাত্র পাইকারি বিক্রয়কেন্দ্র।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

বহুসংস্কৃতির কেন্দ্র

এই অঞ্চলে সুগন্ধি ব্যবসায়ের সঠিক উত্স এখনো অস্পষ্ট। তবে একে ঘিরে গল্পগুলো চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।

অনেক ব্যবসায়ীর মতে—চল্লিশের দশকে ঢাকায় অবাঙালি ব্যবসায়ীদের হাত ধরে সুগন্ধির কারবার শুরু হয়। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই), করাচি ও পাটনা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে থাকেন।

প্রাথমিকভাবে সরু রাস্তায় তিন থেকে চারটি দোকান ঢাকার সচেতন বাসিন্দাদের চাহিদা পূরণ করত। তবে ক্রমশ এর বিস্তার ঘটে। স্থানীয়দের মতে, এই এলাকা এখন প্রায় ৫০০ অ্যালকোহলহীন সুগন্ধি দোকানের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

ওটিস দিয়ে শুরু

রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কেউ হয়তো থেমে যেতে পারেন 'ওটিস পারফিউম হাউস' দেখে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ দোকান কেবল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই নয়, এটি যেন এক অসম্পূর্ণ স্বপ্নের গল্প।

জানা গেছে—দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা কেপি মোহাম্মদ তৎকালীন মাদ্রাজ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে। সেই ব্যবসায়ীর কাছে কেপি মোহাম্মদের বাবা পারফিউম বিক্রি করেছিলেন। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সেই ব্যবসায়ী পণ্য ফেরত দেন। কেপি মোহাম্মদ সেই পণ্য নিয়ে মাদ্রাজে ফিরে না গিয়ে ঢাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।

একটি অস্থায়ী দোকান খুলে সেগুলো বিক্রির সময় কেপি মোহাম্মদ একটি স্থায়ী দোকানের চিন্তা করেছিলেন। এভাবেই জন্ম হয় ওটিসের। বাকিটা ইতিহাস।

এখন কেপি মোহাম্মদের নাতিরা এই ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছেন। ওটিস আধুনিক ঐতিহ্যের মশাল বহন করে চলেছে।

বর্তমান মালিকদের একজন তৃতীয় প্রজন্মের কেপি সাইফ আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকায় ৬ মিটফোর্ড রোডে ওটিসের শুরু। প্রধান কার্যালয়টি এখনো সেখানেই।'

প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনেও পণ্য বিক্রি করে। এখানে প্রধানত সুগন্ধি তৈরি হয়।

সাইফ আরও বলেন, 'আপনি মসজিদের সামনে বা শপিং মলে যেখানেই যান না কেন, দেশের যে কোনো পারফিউমের দোকানে আমাদের পণ্য পাবেন।'

ওটিস এখন ২০ থেকে ২৫ ধরনের পারফিউম তৈরি করে। এর সবচেয়ে জনপ্রিয় পারফিউম হলো 'দরবার' ও 'কস্তূরী'। এর প্রতি আউন্সের দাম ৪৫ টাকা।

তার ভাষ্য, 'দেশে পারফিউম ব্যবসা কখনো বন্ধ হবে না। আমি মনে করি, এই ব্যবসা দিনকে দিন আরও বড় হবে। তবে এর জন্য আমাদের ভালো মানের পণ্য বিক্রি করতে হবে।'

ছবি: পলাশ খান/স্টার

ফারহান পারফিউম: লখনৌর সুবাস

ওটিসের পাশেই ফারহান পারফিউমস।

এর বর্তমান মালিক সরফরাজ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পারফিউম বিক্রি আমার কাছে ব্যবসা নয়। এটি আবেগের বিষয়।'

মধ্যবয়সী সরফরাজের পূর্বপুরুষরা ছিলেন লখনৌর বাসিন্দা। ১৯৬০ সালে যখন তারা ব্যবসা শুরু করেন, তখন এর নাম ছিল লখনৌ আতর কারখানা। সেই সময় ওই এলাকায় মাত্র চারটি সুগন্ধির দোকান ছিল।

পরে দোকানটির নাম রাখা হয় খুশবু পারফিউম হাউস। ঢাকা ও লাহোরে তাদের ব্যবসা। সরফরাজের আত্মীয়রা এখনো পাকিস্তানে খুশবু পারফিউম হাউস নামে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ফারহান পারফিউম মূলত আতর বিক্রি করে। তবে এটি তারা উত্পাদন করে না। তারা ভারত, স্পেন ও ফ্রান্স থেকে পারফিউম আমদানি করে।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

চোখ ধাঁধানো দাম

মিটফোর্ডের ভেতরে লুকিয়ে আছে চমৎকার ও দামি সুগন্ধির জগৎ।

তবে কম দামের সুগন্ধিও আছে। প্রতি আউন্স 'দরবার'র দাম ৪৫ টাকা। 'কস্তূরী' ও 'জান্নাত'র মতো পুরোনো আতরগুলোও এখানে সহজে পাওয়া যায়।

ওটিসের মতো দোকানগুলোয় আছে বিশেষ ধরনের সুগন্ধির পসরা। যেখানে সিলেট অঞ্চলের আগর গাছের এক মিলিলিটার সুগন্ধির দাম ৯০০ টাকা।

তবে এটি হিমশৈলের চূড়া মাত্র।

'আরোশা', 'আসিল', 'আলফ জহুরা', 'আল ফারিস', 'চকো মাস্ক', 'ফাওয়াকাহ', 'রয়েল মিরেজ', 'সালমা', 'সুলতান' ও 'ভিকি'র মতো ব্র্যান্ডের দাম লিটারপ্রতি ছয় হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। কাছাকাছি দামে পাওয়া যায় 'হোয়াইট ওউড'।

মিটফোর্ডের পারফিউম জগতের আসল রত্ন 'এহসাস আল আরাবিয়া' ও 'বিআর ৪৫'। এর দাম প্রতি লিটার ২৪ হাজার টাকা। 'ব্ল্যাক ওউড'র দাম ২০ হাজার টাকা।

স্থানীয় ব্যবসায়ী সাঈদ আনোয়ারের বলেন, 'এগুলো তাদের জন্য, যারা পারফিউমকে শুধু প্রয়োজন মনে করেন না। এগুলো তাদের জন্য যারা মনে করেন পারফিউম ব্যক্তির পরিচয় বহন করে।'

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিলন ডেইলি স্টারকে জানান, এসব সুগন্ধির বেশিরভাগই ভারত, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Private airlines caught in a bind

Bangladesh’s private airline industry is struggling to stay afloat, hobbled by soaring fuel prices, punitive surcharges, and what operators describe as unfavourable policies. Of the 10 private carriers that have entered the market over the past three decades, only two -- US-Bangla Airlines and A

9h ago