দেশে কি নারী বাইকারের সংখ্যা বাড়ছে?
আমাদের দেশে যেখানে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে আরোপিত জেন্ডার ভূমিকার সমাজ ব্যবস্থা, সেখানে এখন দেশের রাস্তাঘাটে যেন শুরু হয়েছে এক শান্ত বিপ্লব। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীদের পথেঘাটে মোটরবাইক চালানোর দৈনন্দিন দৃশ্য যেন নির্দিষ্ট অনেক সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ছাঁচে ফেলা চিন্তাভাবনাকেই চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে।
দিনবদলের এই চিত্র বিভিন্নভাবেই বিশ্লেষণ করা যায়। তবে এর মধ্যে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে, যাতায়াতের ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল একইসঙ্গে সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক। ফলে এটি নারীদের দেশের বিভিন্ন প্রান্ত–শহর কিংবা গ্রামের সরু রাস্তায়ও এনে দিচ্ছে গতিময়তার স্বাদ।
সাদিয়া আফরিন একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি একইসঙ্গে নারীদের বাইকিং কমিউনিটি 'ইয়ামাহা রাইডার্স ক্লাস-গার্লসে'র অ্যাডমিনও। তার এই সফর শুরু হয়েছিল একজন শিক্ষানবিশ রাইডার হিসেবে।
সাদিয়া আফরিন বলেন, '২০১৭ সালে আমি আমার স্কুটি দিয়েই এই যাত্রা শুরু করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং পরে ২০১৮ সালে ইয়ামাহা ফেজার ভি২ চালানো শুরু করি।'
প্রথম প্রথম একটু সংকোচ থাকলেও পরে এই বাহনটিতেই তিনি খুঁজে পান শান্তি ও শক্তি। কারণ এটি তাকে এনে দেয় অন্যরকম স্বাধীনতার স্বাদ।
সাদিয়া বলেন, 'শুরুর দিকে কারো কারো কাছ থেকে কটূক্তি শুনেছি। তবু আমার মনে হয়, দিনে দিনে আরও বেশি মানুষ নারী বাইকারদের প্রতি গ্রহণযোগ্যতার মনোভাব পোষণ করছেন। আমাদের দলের নারী বাইকাররা ইয়ামাহা রাইডার্স ক্লাবের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডেও অংশ নেন।'
এ পর্যন্ত সাদিয়ার অভিযান তালিকায় রয়েছে ভারতের মানালি সফর এবং ২১ ঘণ্টায় তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ যাত্রা।
সাদিয়ার মতোই আলিফা কাশিমও ইয়ামাহা রাইডার্স একাডেমির একজন প্রশিক্ষক। তার একটি রেস্তোরাঁও রয়েছে। একইসঙ্গে মুক্তি ও নিরাপত্তার স্বাদ পেতে আলিফা ২০১৬ সালে নিয়ে নেন তার মোটরসাইকেল লাইসেন্স।
তিনি বলেন, 'প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হয় বলে গণপরিবহনে চড়তে ভয় হয়। তাই ভাবলাম, বাইক থাকলে আমি নিজের মতো স্বাধীনভাবে যাতায়াত করতে পারব। পরিবারের লোকজন আমার বাইক চালানোর পুরোপুরি বিরোধী ছিল। কিন্তু আমার মনে হলো, বাবা ও চাচাদের সবসময় বাইক চালাতে দেখেছি। আমি কেন পারব না?'
এক্ষেত্রে আলিফার স্বামী সবসময়ই তাকে সমর্থন যুগিয়ে গেছেন।
সাদিয়া ও আলিফার যাত্রায় দেশের নারীদের যাতায়াতে, চলাফেরার আসা দিনবদলের চিত্রই ফুটে উঠছে। নারীরা এখন নিজেদের মতো করে মুক্তভাবে ঘুরছেন, ফিরছেন, চড়ে বেড়াচ্ছেন প্রিয় সঙ্গী বাইকে।
এই চর্চায় সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে এসিআই মোটর্সের মতো বিভিন্ন কোম্পানি। বাংলাদেশে ইয়ামাহা মোটরসাইকেলের প্রধান ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে এসিআই মোটর বাইকিং কমিউনিটি সবার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ও সুযোগ পাওয়ার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে।
এসিআই মোটর্সের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাসের সঙ্গে ডেইলি স্টারের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে নারী রাইডারদের প্রচারে কোম্পানিটির বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে জানা যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে নারী বাইকার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছেন? এই প্রবণতার পেছনের কারণগুলো কী বলে মনে হয়?
সুব্রত রঞ্জন দাস: বাংলাদেশ একটি মুক্তমনা দেশ। দিন দিন মোটরসাইকেল বিক্রিও বাড়ছে, আর সেইসঙ্গে নারীরাও বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে নিজেদেরকে আরও বেশি যুক্ত করছেন। তাই নারী বাইকারের সংখ্যা যে বাড়বে, এটিও অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। যদি আমরা ৭ বছর আগের কথাও ভাবি, তখন এ সংখ্যা অনেক কম ছিল। তবে এখন দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। বাংলাদেশে নারী বাইকারও বাড়ছে।
ইয়ামাহার নারী গ্রাহকদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত কত হতে পারে? নারী-পুরুষের অনুপাত কেমন?
সুব্রত রঞ্জন দাস: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মোটরসাইকেল ও স্কুটার দুটোই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তবে নারী-পুরুষের অনুপাতে এখনও ভারসাম্য আসেনি। বাংলাদেশে মোট নিবন্ধিত মোটরসাইকেল সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। কিন্তু সে অনুপাতে আমার জানা মতে, শুধু ৩০ হাজার নারী ব্যবহারকারী রয়েছেন। এ পর্যন্ত ইয়ামাহার এক হাজার নারী ক্রেতা রয়েছেন।
নারী বাইকারদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইয়ামাহা বাইক মডেল কোনটি?
সুব্রত রঞ্জন দাস: বেশিরভাগ নারী এক্ষেত্রে কম সিসির বাইক পছন্দ করেন। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ হাই-এন্ড বাইকের দিকে ঝোঁকেন। যেসব অভিজ্ঞ নারী বাইকারের নিজস্ব বাইক রয়েছে, তাদের মধ্যে ইয়ামাহা আর১৫ বেশি জনপ্রিয়।
নারী বাইকারদের ক্ষমতায়নে এসিআই মোটর্সের নেওয়া বিশেষ কোনো উদ্যোগ বা প্রোগ্রাম?
সুব্রত রঞ্জন দাস: আমরা মনে করি, নারী রাইডারদেরকেই নিজেদের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশজুড়ে আমাদের মোট ১০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে এবং এর মধ্যে ৯টিই ঢাকার বাইরে। এখন পর্যন্ত আমরা দুই হাজার নারী রাইডারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং ক্রমেই এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইয়ামাহা রাইডার্স ক্লাবের একটি 'গার্ল উইং'ও রয়েছে। তারা নিয়মিতই বিভিন্ন সফর এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেয়। কোনো ইভেন্ট স্পন্সর করার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা টেস্ট ড্রাইভের মতো সুযোগ দিয়ে থাকি।
আপনার দৃষ্টিতে নারী মোটরসাইক্লিস্টদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী? এগুলো অতিক্রম করতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
সুব্রত রঞ্জন দাস: এসব চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে আসলে আমাদের সামনে রয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা। এ ছাড়া গণপরিবহনে চলার সময় নারীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। নারীদের চলাচলের ক্ষেত্রে এসব সমস্যার অবশ্যই সমাধান হওয়া উচিত।
এক্ষেত্রে আমি মনে করি, ব্যাংকগুলোর সামনে এগিয়ে আসা দরকার এবং নারী বাইকারদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশেষ স্কিম নিয়ে আসা উচিত। নারী বাইকাররা স্কুটার চালাতেও পছন্দ করেন, কিন্তু বাংলাদেশে স্কুটারের খুব একটা ভালো জোগান নেই। তাই স্কুটার আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমালে নারীদের বাইকিংয়ে সহায়তা হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
নতুন নারী বাইকার, যারা দৈনন্দিন চলাফেরার জন্য বাইকিং শুরু করতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
সুব্রত রঞ্জন দাস: ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, মোটরসাইকেল মানেই স্বাধীনতা। চলাচলের স্বাধীনতা। প্রয়োজন হোক বা আগ্রহ, নিরাপদে চলাফেরার জন্য মোটরসাইকেল একটি দারুণ পছন্দ। এ ছাড়াও মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে সপ্তাহান্তের লম্বা কোনো সফরে বেরিয়ে পড়তে চাইলেও সঙ্গী হতে পারে বাইক।
নারী রাইডারদের দলে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাদের মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। যদি আপনারা বাইকিং শেখার জন্য জায়গা খুঁজে থাকেন, তাহলে আমাদের কাছে আসতে পারেন। অন্য অনেক কোম্পানিও আছে, যারা নারী রাইডারকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এমনকি বর্তমানে মোটরসাইকেল কেনা সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে কাজে লাগার জন্য হলেও এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments