বেইলি রোডে আগুন: কমেছে রেস্তোরাঁয় খাওয়া

রেস্টুরেন্টগুলোতে গত কয়েকদিনে আগের চেয়ে ভিড় কম। গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি খাবারের দোকার থেকে তোলা ছবি। ছবি: রাশেদ সুমন/ স্টার

ঢাকার মোহাম্মদপুরের মুঘল এম্পায়ার রেস্টুরেন্টে গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দেখা যায় একেবারে চুপচাপ, শান্ত অবস্থা। অন্যান্য দিনে সন্ধ্যার এই সময়ে যখন ২৫-৩০ জনের জমায়েত থাকত সেখানে মাত্র চার জন এক কোণে বসে বিরিয়ানি খাচ্ছেন।

শহরের বেইলি রোডে গত সপ্তাহের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে, এক চাপা অস্বস্তির অনুভূতি যেন স্পষ্ট।

বেইলি রোডে গত বৃহস্পতিবার আগুনের ঘটনায় অন্তত ৪৬ জন প্রাণ হারানোর পর এই অবস্থা দেখা দিয়েছে।

মুঘল এম্পায়ার রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মো. নুরুজ্জামান বলেন, আগুনের পর মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়।

'এ কারণে আমাদের বিক্রি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে।'

বৃহস্পতিবারের আগে মোহাম্মদপুর ছাড়াও এর আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন রেস্টুরেন্টে খেতে আসতেন। এখন শুধু মোহাম্মদপুর থেকে মানুষ আসছেন।

কেবল মুঘল এম্পায়ার রেস্তোরাঁই নয়, গ্রাহক ও বিক্রি কমেছে অন্যান্য রেস্তোরাঁরও।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একই এলাকার রুফটপ রেস্তোরাঁ তাজ কিচেনের কথা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেইলি রোডের ঘটনার পর তাদের ব্যবসাও ৩০ শতাংশ কমে গেছে।

ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট রয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে শত শত রেস্টুরেন্ট গত এক দশকে গজিয়ে উঠেছে স্বাস্থ্যকর খাবারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং শহুরে জীবনে নগরবাসীর বাইরে খাওয়ার প্রবণতার তাগিদে।

তবে এই ধাক্কাটি এমন এক সময়ে এল যখন রেস্তোঁরাগুলো ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব থেকে রক্ষায় লড়াই করছে। মূল্যস্ফীতি ২০২২-২৩ সালে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এই প্রবণতা এই বছরেও অব্যাহত আছে।

রেকর্ড মূল্যস্ফীতির চাপে রেস্তোঁরা ব্যবসায় লাভের মার্জিন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান আছে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির (বিআরওএ) তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই কোটি মানুষ এ খাতের ওপর নির্ভরশীল।

তাজ কিচেনের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ২০১৯ সাল থেকে তারা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।  কিন্তু গ্রাহকরা কখনও অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়ে খোঁজ নেননি।

'কিন্তু বেইলি রোডের ঘটনার পর খেতে আসা ক্রেতারা জানতে চান, আমরা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা মেনে চলছি কি না। গ্রাহকরা এখন নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। এটি অবশ্যই একটা ভালো দিক।'

তিনি দাবি করেন, তাজ কিচেন শুরু থেকেই নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।

বেইলি রোডে আগুনে মৃত্যুর ঘটনায় গ্রাহকদের মধ্যেও উদ্বেগ কাজ করছে।

তাদেরই একজন ঢাকার বাসিন্দা খন্দকার রবিন। সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন বাইরে খেতেন তিনি, কিন্তু বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডের পর আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে।

'আমি বাড়ির বাইরে থাকলে এখন আমার পরিবারও খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে।'

অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে বিভিন্ন সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ রেস্তোরাঁগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রেস্তোরাঁ ভবনে পুলিশসহ সরকারি সংস্থাগুলো অভিযান চালাচ্ছে।

গত ৩ মার্চ গুলশান, ধানমন্ডি ও ওয়ারীতে রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে রেস্তোরাঁর মালিক-কর্মচারীসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে ছয়টি মামলা করে পুলিশ।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তারা, যারা বিল্ডিং কোড নিয়ে কাজ করে গত ৪ মার্চ ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে গাউসিয়া টুইন পিক ভবনে অভিযান চালিয়ে ১২টি রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেয়।

একই সড়কে আরেকটি ভবন বন্ধ করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। একই দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ওয়ারীতে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ১৬ জন কর্মীকে আটক করে।

গতকাল বেইলি রোডে রাজউকের অভিযানে যথাযথ অনুমতি না নিয়ে রেস্তোরাঁ পরিচালনা করায় নবাবী ভোজ রেস্তোরাঁ বন্ধ এবং অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় সুইস বেকারিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

সোমবার রাত ১০টার দিকে মিরপুর-১ নম্বরের স্কাই লাউঞ্জের পঞ্চম তলায় গিয়ে দেখা যায় মাত্র দুজন রাতের খাবার খাচ্ছেন।

রেস্টুরেন্টের সুপারভাইজার রফিকুল ইসলাম বলেন, 'স্বাভাবিক সময়ে দিনের এই সময়ে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকত। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও পুলিশের অভিযানের কারণে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে।'

সোমবার সন্ধ্যায় জিগাতলার ম্যানহাটন ফিশ মার্কেট রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, ৬০ জনের বসার জায়গার বিপরীতে মাত্র পাঁচ জন খেতে এসেছেন।

এক কর্মী জানান, যেহেতু গ্রাহক উপস্থিতি কম, তাই তারা সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েছেন। 'কম পরিমাণে খাবার রান্না হচ্ছে।'

মুঘল এম্পায়ারের নুরুজ্জামানের মতে, রেস্টুরেন্ট চালাতে নিয়মিত খরচ আছে। এই অবস্থায় যে ক্ষতি তার পুরোটাই এখন মালিকপক্ষকেই বহন করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

বিআরওএর মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, অনেক রেস্টুরেন্ট ব্যবসা হারাচ্ছে।

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডকে কেন্দ্র করে রেস্টুরেন্ট শিল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, যেভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে এবং মালিক ও কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাতে প্রয়োজনীয় সমাধান নাও আসতে পারে।

তিনি বলেন, রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিলে তা ফলপ্রসূ কিছু হবে না। বরং এতে এ খাতের ক্ষতি হবে এবং অনেকে বেকার হয়ে পড়বে।

বিষয়টি সমাধানে আলোচনার আহ্বান জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
health reform

Priorities for Bangladesh’s health sector

Crucial steps are needed in the health sector for lasting change.

16h ago