বদলে যাওয়া মিরপুরের গল্প
চলতি শতকের শুরুর দিকেও মিরপুর যেন ছিল 'ঢাকার বাইরের এলাকা'। রসিকতা করে 'গ্রাম'ও বলতেন কেউ কেউ।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় ক্রিকেট লিগের ম্যাচ দিয়ে তৎকালীন মিরপুর স্টেডিয়ামে (বর্তমান শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম) যখন ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয়, তখন ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেককেই আক্ষেপ করে বলতে শোনা গিয়েছিল যে 'এত দূরে খেলা দেখতে কেউ যাবে না'।
বাংলাপিডিয়ার সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে মিরপুর ছিল কেরানীগঞ্জ থানা ও পাকিস্তান শাসনের শুরুর দিকে মিরপুর ছিল তেজগাঁও থানার অধীনে। ১৯৬২ সালে মিরপুর প্রথম থানা হয়। এরপর থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকে মিরপুরের গুরুত্ব।
তবে দীর্ঘ সময় মিরপুরের পরিচিতি ছিল তৈরি পোশাক কারখানা, এবড়োখেবড়ো রাস্তা, নোংরা গলিপথ, ভাঙাচোরা বাস, পোশাক শ্রমিকদের বস্তি-বাড়ি তথা রাজধানী ঢাকা লাগোয়া অনুন্নত এলাকা হিসেবে। এমনকি, এখনো ঢাকার কেন্দ্রে বাড়ি ভাড়া বেশি হওয়ায় অনেককে খরচ বাঁচাতে মিরপুরে চলে যেতেও দেখা যায়।
যারা কয়েক দশক ধরে মিরপুরে বাস করছেন বা সেখানেই জন্ম ও বেড়ে উঠা, এক সময় তাদের অনেকেই বলতেন—'ঢাকা যাই'।
কয়েক বছর আগ পর্যন্তও মিরপুরে সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে ঢাকার অন্যান্য এলাকার বাসিন্দাদের অনেককে অন্তত দুই বার ভাবতে হতো। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে কেউ কেউ যেতেন না।
মিরপুরের এমন রূপ গত অন্তত দুই দশকে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে। এটি এখন রাজধানীর দ্রুততম ক্রমবর্ধমান এলাকা। এখানে আছে আকাশছোঁয়া নতুন ভবন, কনডমিনিয়াম, শপিং মল ও খুচরা দোকানের সারি। এর অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি এই এলাকার প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
শাহ আলী, পল্লবী, শেরেবাংলা নগর ও দারুস সালাম থানা নিয়ে মিরপুর বর্তমানে একটি বিকাশমান ব্যবসায়িক ও আবাসিক অঞ্চল।
এমন নতুন পরিচয়ে আসার আগেই মিরপুরে ছিল দেশের সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানা। প্রতিদিন হাজারো মানুষের বিনোদনের স্থান। চিড়িয়াখানার পাশে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা বোটানিক্যাল গার্ডেন দিয়েছে বাড়তি মুগ্ধতা।
আগারগাঁওয়ের তালতলা থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত বিস্তৃত রোকেয়া সরণি দীর্ঘদিন ধরেই আসবাবপত্রের দোকানের বড় কেন্দ্র।
মিরপুরে দেশের সবচেয়ে বড় শাড়ির বাজার বেনারসি পল্লীর পাশাপাশি আছে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অগণিত দোকান।
১৯৭৩ সালে মিরপুর থেকে মিল্কভিটা তরল দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়।
দেশের ক্রিকেটের 'বিকাশ কেন্দ্র' শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠ। এটি বিশ্বকাপ ও আন্তর্জাতিক খেলার অনেক স্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী। ক্রিকেট সূত্রে মিরপুরের পরিচিতি এখন দেশের সীমা ছাড়িয়েছে।
আধুনিক রূপে মিরপুর বিকশিত হতে থাকে মূলত ক্রিকেট স্টেডিয়ামটিকে কেন্দ্র করে। বিশ্বকাপের কারণে মিরপুরের রাস্তা ও অবকাঠামো নতুন রূপ পায়।
মতিঝিল ও পল্টনের যানজটপূর্ণ এলাকা থেকে সরে এসে বেশিরভাগ সরকারি অফিস আগারগাঁও ও শেরেবাংলা নগর এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের পর মিরপুরে আসে আরেক দফা পরিবর্তন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস ইতোমধ্যে এখানে চলে আসায় এই অঞ্চলটি এখন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছে।
মিরপুরবাসীর আরেক অহংকার মেট্রোরেল। যখন সরকার মিরপুরের মাঝ দিয়ে দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শুরু করে তখন মিরপুরবাসী ভীষণ যানজটের দুর্ভোগে ছিলেন। এখন মেট্রোরেল পরিষেবা তাদের সেই কষ্টকে যেন আনন্দের কোমল ছোঁয়ায় দূর করে দিয়েছে।
পল্লবী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ৬১ বছর বয়সী এ বি এম গোলাম মাওলা এক সময় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন করাচিতে। কারণ তার বাবা সেখানে সরকারি চাকরি করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে তারা ঢাকায় চলে আসেন। মিরপুরে কেনেন এক টুকরো জমি।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেড়-দুই দশক আগেও যদি একটি ভালো পাঞ্জাবি কিনতে চাইতেন, যেতে হতো নিউ মার্কেট বা নিউ এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলোয়। জুতার জন্য ছিল গুলিস্তান। কিন্তু এখন দেশের সব জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের আউটলেট মিরপুরে আছে।'
তার ভাষ্য, একটা সময় ছিল যখন রাত ৯টার পর খুব বেশি লোককে বাড়ির বাইরে দেখা যেত না। এখন রাত-গভীরেও রাস্তায় জটলা দেখা যায়।
মিরপুর ও এর আশপাশে আছে উন্নতমানের স্কুল ও হাসপাতাল। জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, কিডনি রোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালের মতো দেশ সেরা চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোয় মিরপুরবাসী সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন।
মিরপুরে স্কলাসটিকার ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ নুরুন নাহার মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১০ সালে মিরপুর ও এর আশেপাশের স্কলাসটিকা শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষার চাহিদা পূরণে আমরা ক্যাম্পাস চালু করি।'
দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল'র বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মিরপুর এখন বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে মধ্যবিত্ত মানুষের বসবাস হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বেশি।'
'এক সময় এটি অনুন্নত এলাকা ছিল। গত ১৫-২০ বছরে মিরপুরের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
এ বি এম গোলাম মাওলার মতে, মিরপুরের জমির দাম দেখলে বোঝা যায় এটি এখন ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় এলাকা।
১৯৯৫ সালের দিকে মিরপুরে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাট বিক্রি হতো পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায়। এখন তা ১৫ হাজার টাকার মতো বলে জানান তিনি।
মিরপুরে অন্যতম শীর্ষ আবাসন প্রতিষ্ঠান বিটিআইয়ের প্রথম প্রকল্প ১৯৯৮ সালে শেষ হয়।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান বলেন, 'মানুষের রুচি বুঝে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। তখন পরিবহন যোগাযোগ আজকের মতো সহজ ছিল না।'
স্থানীয়রা ডেইলি স্টারকে জানান, মিরপুর ডিওএইচএস প্রতিষ্ঠার পরপরই সেখানে আবাসনের চাহিদা বাড়তে থাকে। এ পর্যন্ত বিটিআই মিরপুরের আশপাশে ২৫টি ভবন তৈরি করেছে।
'এখন মিরপুরে গেলে হারিয়ে যাই। গত দুই-তিন দশকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে,' বলেন এফ আর খান।
গত প্রায় ৫১ বছর ধরে মিরপুরে বাস করছেন চিকিৎসক ও টিভি ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার। তার দৃষ্টিতে গত কয়েক বছরে এই এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে সেসব উন্নয়নে ত্রুটিও আছে।
তিনি বলেন, 'খেলার মাঠ দখল করা হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। মিরপুরের আমিনবাজার বর্জ্য ফেলার জায়গায় পরিণত হয়েছে।'
তুষার আরও বলেন, 'আমি যখন মিরপুরে আসি, তখন এখানকার বাতাস ও পানির মান ভালো ছিল। রাস্তার দুই পাশে অনেক গাছপালা ছিল। সেসব এখন অতীত। জীবনযাত্রার মান যদি উন্নত না হয় তাহলে ব্র্যান্ডের দোকান দিয়ে কী করব?'
Comments